যমুনার ১০০ গুণের বেশি টোল দিতে হবে পদ্মায়

জাতীয়

নিউজ ডেষ্ক- পদ্মা রেল সেতু ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশ রেলওয়েকে প্রথম বছরই প্রায় ১০৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকা ভাড়া (ট্যারিফ) দিতে হবে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত হার অনুযায়ী ৩৫ বছর এই ভাড়া বা টোল দিয়ে যেতে হবে। এর জন্য রেলকে ব্যয় করতে হবে ছয় হাজার ২৫২ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। তবে প্রতিবছর টোলের হার ভিন্ন হবে। এর মধ্যে এক বছরে সর্বোচ্চ দিতে হবে প্রায় ২৫১ কোটি ১২ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ রেলওয়েকে গত ২৪ এপ্রিল এই প্রস্তাব পাঠিয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ। আগামী অর্থবছর থেকে প্রস্তাবিত এই ট্যারিফ পরিশোধ করার কথা বলা হয় চিঠিতে। রেলওয়ের মহাপরিচালক ধীরেন্দ্রনাথ মজুমদার গত রবিবার চিঠিটি বুঝে পান। চিঠিতে স্বাক্ষর করেন সেতু কর্তৃপক্ষের সম্পদ বিভাগের উপপরিচালক আঞ্জুমান আরা।

চিঠিতে বলা হয়, পদ্মা বহুমুখী সেতু ব্যবহারকারী সংস্থা বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য আগামী ৩৫ বছরের একটি ট্যারিফসূচি ঠিক করা হয়েছে। অর্থ বিভাগের সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি অনুযায়ী সেতু কর্তৃপক্ষ এই হারে ট্যারিফ আরোপের প্রস্তাব করেছে।

বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুতে প্রতিবছর রেল ভাড়া বা টোল দেয় মাত্র এক কোটি টাকা। সে তুলনায় পদ্মা রেল সেতুর প্রস্তাবিত ট্যারিফ বিপুল অঙ্কের হলেও তা যাত্রীদের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে না। রেল নিজস্ব তহবিল থেকে এই অর্থ শোধ করবে। তবে এতে রেলের ওপর আর্থিক চাপ বাড়বে এবং রেলের লোকসানের অঙ্ক আরো বড় হবে।

পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় বহন করেছে সরকার। এর জন্য সেতু বিভাগের সঙ্গে সম্পাদিত অর্থ বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু ব্যবহারকারী সংস্থাগুলোকে আগামী ৩৫ বছরের মধ্যে ব্যয়ের এই অর্থ সরকারকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যেমন—পদ্মা সড়ক সেতুতে চলাচলকারী পরিবহন থেকে টোল আদায় করা হবে। সেতুর ওপর দিয়ে যাওয়া গ্যাসলাইনের জন্য সংশ্লিষ্ট কম্পানি থেকে অর্থ আদায় করবে সেতু কর্তৃপক্ষ। এসব আয় থেকে সেতু কর্তৃপক্ষ সরকারের হয়ে নির্মাণ ব্যয় তুলে নেবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেতু বিভাগের উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, অর্থ বিভাগের সঙ্গে করা চুক্তি মোতাবেক ২০৫৭ সালের মধ্যে পদ্মা সেতুর ব্যয় সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সেতুর রেল অংশ নির্মাণ করতে যে খরচ হয়েছে, সেই টাকা ৩৫ বছর ধরে রেলের কাছ থেকে নেওয়া হবে।

সেতু কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, আগামী অর্থবছর থেকে সরকারকে টাকা পরিশোধ করা শুরু করবে সেতু বিভাগ। প্রথম বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ফলে সেতু কর্তৃপক্ষও একই সময়ে সেতু ব্যবহারকারীদের কাছ থেকে ভাড়া বা টোল আদায় শুরু করবে।

বঙ্গবন্ধু যমুনা বহুমুখী সেতুর দৈর্ঘ্য ৪.৮ কিলোমিটার। এই সেতুর জন্যও সরকারকে প্রতিবছর প্রায় ২৫০ কোটি টাকা দিয়ে থাকে সেতু বিভাগ। বঙ্গবন্ধু সেতুতে রেল চালানোর ভাড়া বাবদ প্রতিবছর এক কোটি টাকা দেয় রেলওয়ে।

পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার। বঙ্গবন্ধু সেতুর তুলনায় পদ্মা সেতু দৈর্ঘ্য প্রায় দেড় কিলোমিটার বেশি। কিন্তু ভাড়া বা টোল দিতে হবে ১০০ গুণেরও বেশি। কারণ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি।

বঙ্গবন্ধু সেতুর জন্য সরকারকে প্রতিবছর ২৫০ কোটি টাকা দেয় সেতু বিভাগ। এর মধ্যে রেল দেয় মাত্র এক কোটি টাকা। সেতু বিভাগ ২০৩৫ সাল পর্যন্ত সরকারকে টাকা দিয়ে যাবে। কিন্তু পদ্মা সেতুতে এত বিপুল ট্যারিফ কেন জানতে চাইলে সেতু বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, বঙ্গবন্ধু সেতুর জন্য রেলের বছরে সাড়ে সাত কোটি টাকা করে দেওয়ার কথা। কিন্তু রেল বলছে তাদের আয় কম, লোকসানে চলছে। এ কারণে তারা এক কোটি টাকা দেয়।

সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব অনুযায়ী, পদ্মা সেতুতে রেল চালানোর জন্য আগামী অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০৫৬-৫৭ অর্থবছর পর্যন্ত টোল ও ট্যারিফ দিয়ে যেতে হবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০৬ কোটি ৬৬ লাখ টাকার ট্যারিফ দিতে হবে রেলকে। পরের চার বছর প্রায় ১০৫ কোটি টাকা করে দিতে হবে। ২০২৭-২৮ অর্থবছর থেকে ২০৩১-৩২ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় ১৫০ কোটি টাকা করে প্রতিবছর দিতে হবে। পরের পাঁচ বছর দিতে হবে প্রায় ১৪৫ কোটি টাকা করে। ২০৩৭ থেকে ২০৪৭ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর প্রায় ১৮০ কোটি টাকা করে টোল দিতে হবে। শেষের ১০ বছরে দিতে হবে সর্বোচ্চ হারে ট্যারিফ। এই সময়ে প্রায় ২৩০ কোটি থেকে ২৫১ কোটি টাকা পর্যন্ত দিতে হবে।

জানতে চাইলে পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পের পরিচালক আফজাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রস্তাবিত এই ট্যারিফ হারের বিষয়ে আমরা আমাদের মতামত জানাব। আমরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে আমাদের প্রস্তাব ঠিক করব। ’ তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে এত বিশাল অঙ্কের টাকা পরিশোধ করা কঠিন হবে।

রেলওয়ের সূত্র বলছে, আয়ের ওপর ভিত্তি করে ট্যারিফ পরিশোধ করা হবে না। পদ্মা রেল সংযোগ প্রকল্পে টাকা বরাদ্দ আছে। সেখান থেকে সেতুর ট্যারিফ দেওয়া শুরু হবে। তাতে ঘাটতি হলে নিজস্ব তহবিল থেকে টাকা পরিশোধ করবে রেল। এতে রেল এখন প্রতিবছর যে পরিমাণ লোকসান দেয়, সেই অঙ্ক আরো বাড়বে।

জানতে চাইলে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বিশাল অঙ্কের এই ট্যারিফ হয়তো রেলের টিকিটের দামের ওপর প্রভাব ফেলবে না। তবে পরোক্ষভাবে জনগণের ওপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টি হবে। তাই আমি মনে করি, প্রথম তিন থেকে পাঁচ বছর রেল সেতু ট্যারিফমুক্ত রাখা দরকার। ’

অধ্যাপক শামছুল হক বলেন, সরকারের উচিত হবে এই রেলপথ জনপ্রিয় হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা। এরপর প্রথম দিকে ট্যারিফের হার কম রাখা। পরে আস্তে আস্তে বাড়ানো। তা না হলে রেলে লোকসানের বোঝা ভারী হতে থাকবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *