নিউজ ডেষ্ক- নির্বাচনে ইভিএমে (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) ভোটগ্রহণে ধীরগতির সমস্যা নিরসন ও এর গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে কিছু সুপারিশ করেছেন ইসির কারিগরি কমিটির সদস্যরা। এর মধ্যে হ্যাকারদের দিয়ে ইভিএম পরীক্ষার বিষয়টি অন্যতম। ভোটার শনাক্ত করতে আঙুলের ছাপের পাশাপাশি চোখের আইরিশ নেওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন সেল চালু এবং নির্বাচন কর্মকর্তা ও ভোটারদের আরও প্রশিক্ষণের বিষয়েও সুপারিশ করা হয়। বৈঠকে কমিটির সদস্যরা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব আসনে ইভিএম ব্যবহার করতে নির্বাচন কমিশনকে আরও তিন লাখ মেশিন কিনতে হবে। মেশিনগুলো কেনার আগে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান জরুরি। এ সময় বলা হয়, হ্যাকার দিয়ে প্রযুক্তির দুর্বলতা চিহ্নিত করা সারাবিশ্বেই প্রচলিত ও বৈধ পদ্ধতি। সংশ্লিষ্ট সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।
জানা গেছে, বৈঠকে সাম্প্রতিক নির্বাচনে ভোটগ্রহণ প্রক্রিয়ায় ধীরগতির বিষয় নিয়েই মূলত আলোচনা হয়। কমিটির সদস্যরা বলেন, বিদ্যমান কিছু আইন ও বিধিমালা কাগজের ব্যালট পেপার ও ইভিএম-এই দুই পদ্ধতি রেখে তৈরি করা হয়েছে। এ কারণে কিছু আইনগত বিষয় মানতে গিয়ে ভোটগ্রহণে দেরি হচ্ছে। এছাড়া আঙুলের ছাপের মাধ্যমে ভোটার শনাক্তের প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে গিয়েও এ সমস্যা হচ্ছে। তবে শনাক্ত হয়ে গেলে ভোট দিতে বেশি সময় লাগছে না। সভায় বলা হয়, কারিগরি কমিটির সুপারিশ বিদায়ি কেএম নূরুল হুদা কমিশনের কাছে উপস্থাপন করা হবে না। নতুন কমিশনের কাছে দেওয়া হবে।
সূত্র মতে, সদ্যসমাপ্ত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন এবং বেশ কিছু ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভোটগ্রহণে গতি কমে যাওয়ার অভিযোগ ওঠে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয়ী প্রার্থী ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীও ভোটগ্রহণের ধীরগতির অভিযোগ করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার নির্বাচন ভবনে রুদ্ধদ্বার এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (এমআইএসটি), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল, আহসানউল্যাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির ইভিএম বিশেষজ্ঞরা অংশ নেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ।
বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, ভোটারদের কাছে ইভিএমে ভোটগ্রহণ কীভাবে আরও দ্রুত ও সহজ করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সম্প্রতি কয়েকটি নির্বাচনে ইভিএমে ধীরগতির বিষয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর এসেছে। এগুলো কীভাবে সমাধান করা যায় তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বেশ কিছু সুপারিশ এসেছে, এগুলো কমিশনে উপস্থাপন করা হবে।
বৈঠক সূত্র জানায়, ইসির এ কারিগরি কমিটির সর্বশেষ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৮ সালের ৭ নভেম্বর। তিন বছরের বেশি সময় ধরে সভা হয়নি। বৃহস্পতিবার বৈঠকে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্তগুলোর অগ্রগতি তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, ওই সভার বেশিরভাগ সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন হয়েছে। বর্তমানে ইভিএম কাস্টমাইজেশন ইসির নিজস্ব কর্মকর্তা দিয়েই শুরু হয়েছে। ইভিএমে ভিভিডিএটি (ভোটার ভেরিফিকেশন ডিজিটাল অডিট ট্রায়াল) প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। এতে ভোটাররা কোন প্রতীকে ভোট দিচ্ছেন তা স্কিনে দেখতে পাচ্ছেন। ‘আপনার ভোটটি সম্পন্ন হয়েছে’ এমন শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। এছাড়া কারিগরি কমিটির উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী মারা যাওয়ায় ওই পদটি বিলুপ্তির প্রস্তাব আসে। একই সঙ্গে কয়েকজন সদস্যের চাকরিগত অবস্থান পরিবর্তন হওয়ায় কমিটির পুনর্গঠনের বিষয়ে আলোচনা হয়।
সূত্র আরও জানায়, নির্বাচনে ভোটার দ্রুত শনাক্ত করার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। একই সঙ্গে ইভিএম নিয়ে এখনো বিভিন্ন মহলে বিতর্ক থাকায় তা নিরসনের ওপর জোর দেওয়া হয়। সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, ইভিএম নিয়ে এখন প্রশ্ন নেই বললেই চলে। অনেক দল রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে এ প্রযুক্তি নিয়ে বক্তব্য দিচ্ছে। আমরা ইভিএম আরও গ্রহণযোগ্য করতে হ্যাকারদের আহ্বান করতে পারি। হ্যাকাররা ইভিএম হ্যাক করার চেষ্টা করবে। তারা যদি সফল হয় তাহলে তাদের পুরস্কৃত করা যায়। তিনি বলেন, হ্যাকাররা চেষ্টা করলে হয়তো কিছু ত্রুটি বের করতে পারবে। ওইসব ত্রুটি সমাধান করতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের প্রচলন রয়েছে। প্রযুক্তিতে এ কৌশলের প্রয়োগ দরকার। তিনি আরও বলেন, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ‘রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেল’ গঠন করা যেতে পারে। ওই সেল প্রতিনিয়ত ইভিএম নিয়ে গবেষণা করবে। কীভাবে এ প্রযুক্তির উন্নয়ন করা যায় সেই চেষ্টা করবে।
বৈঠকে জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক একেএম হুমায়ূন কবীর বলেন, ইভিএমে আঙুলের ছাপ দিয়ে ভোটার শনাক্ত করা হয়। নানা কারণে অনেক সময়ে ভোটারদের আঙুলের ভাঁজগুলো নষ্ট হয়ে যায়। এতে ভোটার শনাক্ত করতে সময় লেগে যায়। বর্তমানে জাতীয় পরিচয়পত্র তথ্যভান্ডারে প্রায় ৬ কোটি নাগরিকের চোখের আইরিশ রয়েছে। ইভিএমে আইরিশ স্ক্যানার সংযুক্ত করা যায়। এটি আঙুলের ছাপের বিকল্প হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
বৈঠকে অন্য সদস্যরা বলেন, বর্তমানে আইন অনুযায়ী ভোটারের স্বাক্ষর নেওয়া হয় এবং তার আঙুলে অমোচনীয় কালি দেওয়া বাধ্যতামূলক। কাগজের ব্যালটে ভোট নিতে এ প্রক্রিয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে। ইভিএম প্রযুক্তিতে এ দুটির কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। ইভিএমে দ্বিতীয়বার ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। এসব প্রক্রিয়া করতেও সময় বেশি লাগছে। এক শিক্ষক বলেন, ইভিএমে ইসিজি স্ক্যানার বসানো যেতে পারে। তিনি যুক্তি দিয়ে বলেন, একজনের ইসিজির সঙ্গে আরেকজনের ইসিজির মিল নেই। বর্তমানে বহনযোগ্য দুই পোর্টের ইসিজি মেশিন রয়েছে। ওই প্রযুক্তির মাধ্যমে সহজেই ভোটার শনাক্ত করা যাবে।