পাহাড় কেটে তৈরি করা হচ্ছে পাকা ঘর, উঠছে দালান

বাংলাদেশ breaking subled

নিউজ ডেষ্ক- চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামী, আকবরশাহ, খুলশীসহ নগরের বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচারে পাহাড় কাটা হচ্ছে। বায়েজিদ বোস্তামীতে পাহাড় কেটে প্লট বাণিজ্য চলছে। এসব প্লটে দালান বানিয়ে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগ নেওয়া হয়েছে। প্লটের নিরাপত্তায় বসেছে সিসিটিভি ক্যামেরা।

অভিযোগ রয়েছে, পাহাড়ে অবৈধভাবে নির্মিত দালানের বাসিন্দারা পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে নিয়মিত উৎকাচ দেয়। উৎকাচ না পেলে তাঁরা অভিযান পরিচালনা করেন। অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসন বলছে, তারা অভিযোগ পেলেই অভিযান চালাচ্ছে। তবে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারণ অভিযান বন্ধ হলেই আবার পাহাড় কাটা হচ্ছে।

২ জুলাই বায়েজিদ বোস্তামী থানার মাঝিরঘোনায় দেখা গেছে, লিংক রোড থেকে ডান পাশে একটি সড়ক নেমেছে। সড়কমুখে ইটের দেয়ালে সাঁটানো লিফলেটে লেখা, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরায় নজরদারি চলছে। একটু দূরেই চোখে পড়ল গাছে লাগানো সিসিটিভি ক্যামেরা। আরো সামনে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে ‘গলাচিপা’ নামক সড়কপথ। ভরদুপুরে ঝিরিপথের ওই প্রান্তে দেখা গেল, পাহাড়ে পড়া কোপে সদ্য বেরিয়ে আসা মাটি। অপরিচিত লোক দেখেই সরে যান পাহাড় কাটার কাজ তদারককারীরা। সেখানকার সব পাহাড়েই কোপ পড়েছে। উঠেছে ঘর, নির্ধারণ করা হয়েছে প্লটের সীমানা। আরো গহিনে গিয়ে দেখা গেল, ৪০ ফুট উঁচু পাহাড় কেটে প্লট তৈরি হয়েছে।

পাশেই পাহাড় চূড়ায় উঁচুতে উঠতে তৈরি হয়েছে সড়কপথ। সেখানে দুটি পাহাড় কেটে মাঝখানে দুই কক্ষের একটি পাকা বাড়ি নির্মিত হচ্ছে। ভরদুপুরে শ্রমিকদের কাউকে পাওয়া গেল না।

পাহাড়ে অবৈধভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর নির্মাণ প্রসঙ্গে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মোহাম্মদ কামরুজ্জামান বলেন, দুর্গম পাহাড়ে নির্জনতার সুযোগে প্রতিনিয়ত পাহাড় কাটা হচ্ছে। গত জুনে ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে উচ্ছেদ অভিযানের পর আবারও চলছে ঘর নির্মাণকাজ।

স্থানীয় বাসিন্দা আলী আকবর বললেন, ‘এখানে ভাড়া ঘরে থাকি। পানি, বিদ্যুৎ, ডিশ লাইন আছে। তবে সড়ক যোগাযোগ সমস্যা। ’ পোশাককর্মী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘এক হাজার ৮০০ টাকায় দুই কক্ষের ঘরে সংসার নিয়ে থাকি। দালানে থাকার সামর্থ্য নেই। ’

একই কায়দায় আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল, সলিমপুরে এলাকায় একই কায়দায় পাহাড় কাটা হচ্ছে। নগরীর ভেতরে চকবাজার থানা এলাকার ম্যানিলা হিল আংশিক কেটে ফেলা হয়েছে। অবশ্য পরিবেশ অধিদপ্তর ম্যানিলা পাহাড় থেকে কয়েকজন শ্রমিককে আটক করেছিল। অভিযোগ আছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের জ্ঞাতসারে ম্যানিলা পাহাড় কাটা হচ্ছিল।

বায়েজিদ বোস্তামীতে ‘মাঝেরঘোনা সমাজকল্যাণ হাউজিং সোসাইটি’ আবাসিকের সঙ্গে জড়িত ১২ জনের নাম পাওয়া গেছে। বায়েজিদ বোস্তামী থানার তথ্য অনুযায়ী, এই সোসাইটির জন্য পাহাড় কেটেছেন শাহজাহান ওরফে লাল বাদশা, মো. জামাল, সোসাইটির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন, আজিজুল হক, কামাল, জাহাঙ্গীর, আতিক, রড মানিক, অংশি মারমা, সাকিব, খালেক ওরফে মানিক ও নাছির। তাঁরা প্রত্যেকে চার থেকে ১২টি মামলার আসামি। পাহাড় কাটার শ্রমিক সরবরাহ করেন বাদশা ও আরিফ। নিজের নামে বৈদ্যুতিক মিটারের সংযোগ নিয়ে অন্য ঘরে সরবরাহ করেন বাদশা। ইন্টারনেট সংযোগ দেন আবদুল খালেক। পাহাড় কেটে এক হাজার ৬০০ বর্গফুটের প্লট তিন থেকে ছয় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়। আবাসিকে পানি সরবরাহ করেন বাদশা, কামাল, এয়ার মোহাম্মদ ও রড মানিক।

একটি প্লটের ক্রেতা মনির আহমদ বলেন, ‘চার লাখ টাকায় পাহাড়ি জমি কিনে টিনের বাড়ি করেছি। জমির রেজিস্ট্রেশন হয়নি; স্ট্যাম্পে লিখিত হয়েছে। ’

যোগাযোগ করলে আরিফ হোসেন অভিযোগ অস্বীকার করে গতকাল সোমবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি সোসাইটির সভাপতি নই। পাহাড় কেটে প্লট বিক্রি করেছি—এর দালিলিক প্রমাণও নেই। শুধু অভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে হেয়প্রতিপন্ন করতেই এসব অভিযোগ করা হচ্ছে। ’

আকবরশাহ থানার ১ নম্বর ঝিল বাসিন্দাদের ভাষ্য মতে, পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা পাহাড় পরিদর্শনে যান না। অতিবর্ষণের সময় চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ধার কার্যক্রম চালান। পরিবেশ অধিদপ্তরের নোটিশ জারিকারকসহ কিছু নিম্নপদের কর্মচারী টাকা হাতিয়ে নেন দালালদের মাধ্যমে। মাঝেরঘোনার বাসিন্দারা বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে নিয়মিত টাকা পাঠাতে হয়। টাকা না পাঠালে ম্যাজিস্ট্রেট-পুলিশ নিয়ে ঘর ভেঙে দেয়। সেখানকার বাসিন্দা হাবিব মোল্লা বলেন, ‘পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকের কাছে সরাসরি টাকা দিই না। সমিতির মাধ্যমে পৌঁছানো হয়। ’

সরকারি সংস্থার মধ্যে পাহাড় কেটেছে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ)। ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড নির্মাণ করেছে ১৫টি পাহাড় কেটে। খাড়া করে পাহাড় কেটে সড়ক তৈরির পর সংস্থাটি এখন বলছে, ঝুঁকিমুক্ত করতে পাহাড় আবারও কাটা প্রয়োজন।

চট্টগ্রাম সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী নগরের জলাবদ্ধতার জন্য পাহাড় কাটাকে দায়ী করেছেন। ২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বছরে পাহাড়ধসে মারা গেছে তিন শতাধিক মানুষ। সর্বশেষ গত জুন মাসে মারা যায় চারজন।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক এস এম সিরাজুল হকের ‘হিল কাটিং অ্যান্ড অ্যারাউন্ড চিটাগং সিটি’ শিরোনামে গবেষণা প্রকাশিত হয় ২০১১ সালে। এতে বলা হয়, বায়েজিদ, খুলশী, পাহাড়তলী, মতিঝর্না, ষোলশহর ও ফয়’স লেক এলাকায় সর্বাধিক পাহাড় কাটা হয়েছে। ১৯৭৬ সাল থেকে পরবর্তী ৩২ বছরে ৮৮টি পাহাড় সম্পূর্ণ এবং ৯৫টি আংশিক কাটা হয়। সবচেয়ে বেশি পাহাড় কাটা হয়েছে পাঁচলাইশে। ১৯৭৬ সালে নগরীতে পাহাড় ছিল ৩২.৩৭ বর্গকিলোমিটার। ২০০৮ সালে তা কমে ১৪.০২ বর্গকিলোমিটারে নেমে আসে।

পরবর্তী সময়ে ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব ন্যাচারাল অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্সেসে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এনভায়রনমেন্টাল ডিগরিডেশন থ্রো হিল কাটিং ইন চিটাগং ডিস্ট্রিক্ট অব বাংলাদেশ’ শিরোনামে গবেষণাপত্র। এতে বলা হয়, নগরের ২০০ পাহাড়ের মধ্যে ১০০ পাহাড় কেটে আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে।

২০১৭ সালে পাবর্ত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ধসে ব্যাপক প্রাণহাণির পর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় ভূমিধসের কারণ ও করণীয় সম্পর্কে প্রতিবেদন দিতে একটি কমিটি করেছিল। সেই কমিটির আহ্বায়ক ও তৎকালীন অতিরিক্ত সচিব সত্যব্রত সাহা একটি প্রতিবেদন দিয়েছিলেন। সেই প্রতিবেদনে যে সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলো বাস্তবায়িত করা হয়নি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বন ও পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, ‘মহানগরীতে বর্ধিত জনসংখ্যার চাপ সামাল দিতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পাহাড় নিধন হচ্ছে। নাসিরাবাদ ও পাঁচলাইশ আবাসিক এলাকা হয়েছে পাহাড় কেটে। পাহাড়চূড়ায় বাংলো বানিয়ে সরকারি কর্তারা বাস করছেন। আর প্রভাবশালী পাহাড়খাদকরা পাহাড় কাটছেন। এমন নিধনযজ্ঞ চললে এই শতকের শেষের দিকেই হয়তো মরুভূমিতে পরিণত হবে চট্টগ্রাম। ’

নির্বিচারে পাহাড় কাটার বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম মেট্রো অঞ্চলের উপপরিচালক মিয়া মাহমুদুল হক বলেন, অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। চলতি বছরের অভিযানের তথ্য জানতে চাইলে তিনি বিরক্তি প্রকাশ করে এই প্রতিবেদককে ‘তথ্য অধিকার আইনে’ আবেদন করার পরামর্শ দেন।

চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান বলেন, ‘পাহাড়ে শত শত ঘরে হাজারো মানুষের বাস। প্রতি বর্ষায় প্রশাসন উচ্ছেদ করে; কিন্তু পরে তারা ফের ফিরে যায়। তাই এখন বৃক্ষরোপণ করে পাহাড় রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *