নিউজ ডেষ্ক- সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দায়িত্বহীনতার কারণে ২ বছরের প্রকল্প ঠেকেছে ৯ বছরে। শুধু সময়ই বাড়েনি, বেড়েছে ব্যয়ও। ৩৭ কোটি ৩২ লাখ টাকার প্রকল্প এখন দাঁড়াচ্ছে ৯০ কোটি ৭৩ লাখ টাকায়। এক্ষেত্রে সরকারকে বাড়তি গুনতে হবে ৫৩ কোটি ৪১ লাখ টাকা, যা শতাংশের দিক থেকে হয় ১৪৩ শতাংশ। এমনকি মূল ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) তৈরির সময় প্রকল্পের কোনো মাস্টারপ্ল্যান বা স্টাডি রিপোর্ট ছিল না। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর তৈরি করা মাস্টারপ্ল্যান, জরিপ এবং বাস্তব প্রয়োজনে বিভিন্ন কার্যক্রম যুক্ত ও বাদ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পে রয়েছে ধীরগতি।
‘উত্তরা লেক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পে এমন দূরবস্থা বিরাজ করছে। এতসব অনিয়মের মধ্যে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব একনেকে (জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি) উপস্থাপন করা হচ্ছে আজ (মঙ্গলবার)। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসন শেখ হাসিনা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হয়তো বৈঠকে সময় ও অর্থ বৃদ্ধির প্রস্তাব অনুমোদন পাবে। কিন্তু এই বৈঠক থেকে দায়ীদের চিহ্নিত করে তাদেরকে জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা উচিত। একই সঙ্গে আগামীতে অন্য কোনো প্রকল্পে যাতে এ রকম ঘটনা না ঘটে, সেজন্য কঠোর নির্দেশনা দেওয়া দরকার।
প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সাবেক সদস্য ও বর্তমানে পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশীদ সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘এটি দেরি হওয়ার পেছনে সবাই দায়ী। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও মন্ত্রণালয় যেমন দায়ী, তেমনি পরিকল্পনা কমিশনের আমরাও দায়ী’। তিনি মনে করেন, ‘অনুমোদনের সময়ই দেখা উচিত ছিল স্টাডি ও মাস্টারপ্ল্যান ঠিকমতো হয়েছে কি না। এসব বিষয়ে জবাবদিহিতা দরকার।’ তিনি জানান, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের মধ্যে সরকারি তহবিলের অর্থ খুব কম। আর বাস্তবায়নকারী সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন (রাজউক) কর্তৃপক্ষের টাকাই বেশি। যে ব্যয় বাড়ছে সেটি ওই সংস্থার তহবিল থেকে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বর্তমান সরকারের যে কৃচ্ছ সাধনের প্রক্রিয়া চলছে এতে করে এমন প্রকল্প সংশোধনী অনুমোদন দেওয়ার কথা নয়। উপরন্তু নিয়ম-কানুন না মেনেই প্রকল্পটি তৈরি করা হয়েছিল। এ ঘটনার জন্য ওই সময় প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সব সংস্থাই দায়ী। ফলে ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের যেনতেন প্রকল্প প্রস্তাব যাতে না আসে সেজন্য বিদ্যমান বিধিবিধানের কঠোর প্রয়োগ করতে হবে।
সূত্র জানায়, ‘উত্তরা লেক উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে উত্তরা লেক দখল হওয়া থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। এছাড়া লেকের চারপাশে হাঁটার সুবিধা এবং ডাইভারশন ড্রেনেজের মাধ্যমে দূষণ প্রতিরোধ, পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করে প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন এবং নগরীর নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি ও চিত্তবিনোদন সুবিধার উন্নয়ন হবে বলে আশা করছেন প্রকল্পের দায়িত্বশীলরা। মূল প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৪ সালের ২১ মে। এ সময় বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৪ সালের জুলাই থেকে ২০১৬ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু সময় মতো কাজ শুরু না হওয়ায় পরবর্তী সময় দুই দফায় বাস্তবায়নের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়। এখন প্রথম সংশোধনীতে ৩ বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
এদিকে ২০২১ সালের জুন পর্যন্ত প্রকল্পের ক্রমপুঞ্জিত ব্যয় হয়েছে মাত্র ২৯ কোটি ৩৪ লাখ ৫৭ হাজার টাকা। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৩২ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি হয়েছে সাড়ে ৩৩ শতাংশ।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাজউকের সদস্য (উন্নয়ন) মেজর (ইঞ্জিনিয়ার) সামসুদ্দীন আহমদ চৌধুরী (অব.) সোমবার যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ছোট করে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এটা বড় করা হয়েছে। বাস্তবায়নে দেরি হওয়ার কারণে ব্যয় বাড়েনি। নতুন বেশ কিছু কাজ এবং ভূমি অধিগ্রহণ যোগ হওয়ায় এর ব্যয় বৃদ্ধি পেয়েছে।’ তিনি জানান, আগে লেকের পাশের প্রায় সব বাড়ি ও অফিসের ময়লা ফেলার পাইপ লেকের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ফলে এত অনেক ময়লা-আবর্জনা জমে যায়। সেগুলো পরিষ্কার করা হচ্ছে। সেইসব পাইপের মুখ লেক থেকে সরিয়ে একটি সিস্টেমে নিয়ে আসা হচ্ছে। পুরো লেকেই জুড়েই প্রায় ৪ মিটার চওড়া ওয়ার্কওয়ে করা হচ্ছে। এ রকম নতুন অনেক কাজ যুক্ত করা হয়েছে।
প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়েছে, উত্তরা আবাসিক মডেল টাউনের ৯৫ শতাংশ এলাকাতেই এখন অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এখানে প্রায় ৫ থেকে ৭ লাখ লোকের বাস। কিন্তু উত্তরা লেক ছাড়া এখানে আর কোনো জলাধার নেই। আশপাশের নদীর সঙ্গে লেকটির সংযোগও যথেষ্ট সচল নয়। ফলে বৃষ্টি হলেই এখানে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। পাশাপাশি লেকটির চারধারে সৌন্দর্য উপভোগ করার মতো কোনো অবকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধা নেই। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রকল্পটি হাতে নেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটির সংশোধনী প্রস্তাব পাওয়ার পর গত বছরের ৩১ মে অনুষ্ঠিত হয় প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভা। ওই সভার সুপারিশে বলা হয়, সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাবে ব্রিজ, কালভার্ট ও ফুটওভার ব্রিজ বাদ দেওয়ার কারণ উল্লেখ করতে হবে। এর জবাবে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানায়, ২০১৯ সালের ২৯ এপ্রিল গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সভাপতিত্বে সংশোধিত ডিপিপির ওপর অনুষ্ঠিত হয় পর্যালোচনা সভা। সেখানে সেতু নির্মাণ, বক্স কালভার্ট এবং প্রবেশ গেটসহ সীমানা দেওয়াল নির্মাণ খাতে ব্যয় বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এর পরিবর্তে লেক খনন, স্লোপ প্রোটেকশন কাজ ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ অন্তর্ভুক্ত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। তাই এ খাত দুটি বাদ দেওয়া হয়। পরামর্শকদের করা ডিজাইন ও সম্ভাব্যতা সমীক্ষায় এই কাজের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে পরবর্র্র্র্তীতে ভিন্ন ডিপিপি তৈরি করে নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়া হবে।
প্রকল্পের মূল কার্যক্রম হচ্ছে, ভূমি অধিগ্রহণ ও স্থাপনার ক্ষতি পূরণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ এবং মাটি ভরাট করা হবে। এছাড়া তীর সংরক্ষণ, অপসারণ, বিদ্যুতায়ন, ৩০০ এমএম পাইপ স্থাপন, ৬০০ এমএম পাইপ স্থাপন, ৯০০ এম এমআরসিসি পাইপ এবং ইন্সপেকশন এলাকা তৈরি করা হবে। সেই সঙ্গে ক্যাচ পিট, গ্রাস টার্ফি, ওয়েস্ট বিন স্থাপন এবং রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ করা হবে।
প্রকল্প সংশোধনের কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, বাস্তব প্রয়োজনে রিটেইনিং ওয়াল নির্মাণ, ক্যাচ পিট এবং ওয়েস্ট বিন স্থাপন অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া সেতু নির্মাণ, বক্স কালভার্ট, আরবরিকালচার (গাছ লাগানো), যানবাহন ক্রয়, বিদ্যমান কালভার্ট পুনর্বাসন এবং ডিওয়াটারিং অঙ্গ বাদ দেওয়া হয়েছে। এসব কার্যক্রম বাদ দেওয়ার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, অনুমোদিত ডিপিপিতে বক্স কালভার্ট নির্মাণ ও সেতু নির্মাণ খাতের ব্যয় বাস্তবসম্মত ছিল না। ফলে হালনাগাদ রেট শিডিউল অনুযায়ী ব্যয় প্রাক্কলনে দেখা যায় এ খাতে ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পায়। তাই এসব কাজ বাদ দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্পের কাজ সুষ্ঠুভাবে শেষ করার জন্য মেয়াদ ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো দরকার। এজন্যও কিছু খরচ বেড়েছে।