নিউজ ডেষ্ক- ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন শ্রীহট্ট অঞ্চলে মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে পুরো সিলেট অঞ্চলে ব্যাপকভাবে ইসলাম ধর্ম প্রচার হতে শুরু করে।
ইসলাম ধর্ম ব্যাপকভাবে বিস্তারের পাশাপাশি শ্রীহট্ট অঞ্চলে সুলতানি আমলে অসংখ্য অপূর্ব কারুকার্যময় মসজিদ নির্মিত হয়েছিল। সেই আমলে নির্মিত বহু মসজিদের শিলালিপি পাওয়া গেলেও পুরো শ্রীহট্ট অঞ্চলে এখন অস্তিত্ব রয়েছে মাত্র একটি মসজিদের। বাকিগুলোর এখন আর কোনো অস্তিত্ব নেই।
সুলতানি আমলের যে মসজিদটি এখনো টিকে আছে, সেটি হচ্ছে হবিগঞ্জ জেলার রাজিউড়া ইউনিয়নের উচাইল শাহী মসজিদ। স্থানীয়দের কাছে এ মসজিদটি গায়েবি মসজিদ নামে পরিচিত।
এ ধরনের মসজিদের নমুনা দেখা যায় দিনাজপুরের সুরা মসজিদ, পটুয়াখালীর মসজিদবাড়ি মসজিদ ও গৌড়ের খনিয়া দিঘি মসজিদে। ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া শাহজীবাজার রেলস্টেশন থেকে মাত্র আট কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত সিলেট বিভাগে সুলতানি আমলের সর্বশেষ নিদর্শন এ মসজিদটি দেখতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোক সমাগম হচ্ছে।
উচাইল শাহী মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৪৫ ফুট এবং প্রস্থ ৩২ ফুট। মসজিদের চারকোণে চারটি ও বারান্দার দুই কোণে দুটি অষ্টকোণ আকৃতির মিনার আছে। কেন্দ্রীয় মেহরাবের দুধারে পেছনের দেওয়ালেও দুটি মিনার ছিল বলে জানা গেছে। গত কয়েক বছর আগে মসজিদটি সংস্কারের সময় এ দুটি মিনার ভেঙে ফেলা হয়। বর্গাকারে নির্মিত মসজিদটির কেন্দ্রীয় কক্ষের ভেতরের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থ সমান। দুটিই ২১ ফুট ৫ ইঞ্চি। কেন্দ্রীয় মসজিদ কক্ষের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দেওয়ালে আছে তিনটি করে প্রবেশপথ।
ভেতরের পশ্চিম দেওয়ালে তিনটি মেহরাব আছে। কেন্দ্রীয় মসজিদ কক্ষের বাইরে বারান্দার পূর্ব দেওয়ালে তিনটি এবং উত্তর ও দক্ষিণ দেওয়ালে একটি করে প্রবেশপথ আছে। মসজিদের কেন্দ্রীয় কক্ষের ওপরে বিরাট আকারের গম্বুজ ছিল বলে জানা যায়। ওপরের এ গম্বুজটি কালের বিবর্তনে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলে লোহার বর্গার ওপরে সমগ্র মসজিদে সমতল ছাদ নির্মিত হয়েছে। একই সঙ্গে মসজিদটির অনেক অবকাঠামো পরিবর্তন করা হয়েছে। সুলতানি আমলে বাঁকাভাবে নির্মিত কার্নিশ ও প্যারাপেট সরল রেখায় নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। কোণের মিনারগুলোকেও তোলে দেওয়া হয়েছে ছাদের অনেক ওপরে।
এতে সুলতানি আমলে নির্মিত মসজিদটির আদি ও আসল রূপ অনেকটা ম্লান হয়ে গেলেও মসজিদের আদি অলংকরণের বেশ কিছু নিদর্শন এখনো মসজিদটির গায়ে অক্ষত আছে। মসজিদের দেওয়ালগুলোর বাইরের দিকে পোড়ামাটির চিত্র ফলকের সাহায্যে অতি মনোরম অলংকরণের কিছুটা এখনো অক্ষত রয়েছে। এক সময় পুরো মসজিদের বাইরের দেওয়াল এভাবে পোড়ামাটির অলংকরণ ছিল। বর্তমানে যার অনেকটাই নষ্ট হয়ে গেছে।
শাহী মসজিদটির মেহরাবগুলোর অলংকরণও ছিল অত্যন্ত উঁচু মানের। পত্রকারে নির্মিত মেহরাবগুলোর উপরিভাগে খাঁজকাটা ছিল। মেহরাবের ফ্রেমের স্তম্ভগুলোতে লতার সাহায্যে অসংখ্য ছোট ছোট বর্গ ও আয়তনক্ষেত্রের সৃষ্টি করে সেগুলোর ভেতরে চার বা আট দল বিশিষ্ট পুষ্পের প্রতিকৃতি অঙ্কিত করা হয়েছিল। মেহরাবের ভেতরের স্তম্ভগুলোতে ছিল ঝুলন্ত শিকল ও ঘণ্টার প্রতিকৃতি।
মেহরাবের উপরিভাগ ও ভেতরে ছিল লতাপাতা ও পুষ্পর প্রতিকৃতি। এমন সুন্দর মনোমুগ্ধকর অলংকৃত মসজিদ বাংলাদেশে রয়েছে হাতেগোনা। উচাইল (শঙ্করপাশা) শাহী মসজিদটির অনেক আদি অলংকরণ ইতোমধ্যে নষ্ট হয়ে গেলেও এখনো যেটুকু অলংকরণ টিকে আছে তাই পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। উচাইল (শঙ্করপাশা) শাহী মসজিদের কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি।
তবে মসজিদের গঠন পদ্ধতি ও শিল্প কৌশল দেখে বিশেষজ্ঞদের অভিমত এ মসজিদটি সুলতানি আমলেই নির্মিত হয়েছিল এবং তা খুব সম্ভবত সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ’র রাজত্বকালে নির্মিত বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। মসজিদের দক্ষিণপ্রান্তে রয়েছে হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর সফরসঙ্গী শাহ মজলিশ আমিন (রহ.) এর মাজার শরিফ। তিনি ইসলাম প্রচারে বাংলাদেশে এসে তরফ অঞ্চলে ধর্ম প্রচার শুরু করেন। আদিকালে উচাইল গ্রামের নাম ছিল শঙ্করপাশা। কিন্তু এলাকায় ইসলামের বাণী প্রচারে এসে শাহ মজলিশ আমিন (রহ.) এ গ্রামের নামকরণ করেন উচাইল। এখন এ নামেই পরিচিত গ্রামটি। লেখক : গণমাধ্যমকর্মী ও কলাম লেখক