নিউজ ডেষ্ক- নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায় বিএনপি। এ দাবি আদায়ে আন্দোলন গড়তে ‘সরকারবিরোধী জোট’ গঠনের চেষ্টা করছে দলটি। সিনিয়র নেতা, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, পেশাজীবীসহ বিশিষ্ট নাগরিকদের মতামত নিয়ে ইতোমধ্যে নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখার প্রাথমিক খসড়া তৈরি করা হয়েছে।
সেখানে আগামী নির্বাচনে জয়লাভ করলে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হবে-এমন প্রতিশ্রুতি রয়েছে। একই সঙ্গে নিরপেক্ষ সরকার কেমন হবে, কারা থাকতে পারেন-এসব বিষয়ও আছে খসড়ায়। এর ওপর প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা নিতে দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে লন্ডন গেছেন স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুসহ দুই নেতা৷তিনি দেশে ফিরলে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে আরও সংযোজন-বিয়োজন করে তা চূড়ান্ত করার কথা রয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ রূপরেখা আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হবে। বিএনপির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।
আরও জানা গেছে, নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখার প্রাথমিক খসড়ায় উল্লেখ করা হয়েছে, এই সরকারে যারা থাকবেন সাধারণত নির্বাচন পরিচালনা করাই তাদের প্রধান কাজ হবে। দুই নির্বাচনের মধ্যকার সময়ে নিরপেক্ষ সরকার ৩ মাসের জন্য ক্ষমতায় থাকবেন। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাতিল হওয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান ছিল-সুপ্রিমকোর্টের সর্বশেষ অবসর গ্রহণকারী প্রধান বিচারপতি প্রধান উপদেষ্টা হিসাবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং তাকে একদল উপদেষ্টামণ্ডলী সাহায্য করবেন। কিন্তু বিএনপির নিরপেক্ষ সরকারের ফর্মুলায় তা থাকছে না। এই সরকারে কারা থাকবেন তা নিয়ে কয়েকটি প্রস্তাব আছে। যা নিয়ে আরও পর্যালোচনা করা হচ্ছে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের আরও দিকনির্দেশনার পর জাতীয় স্থায়ী কমিটি আরও সংযোজন-বিয়োজন করে তা চূড়ান্ত করবেন৷ জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর যুগান্তরকে বলেন, নিরপেক্ষ সরকারের অধীনেই আগামী জাতীয় নির্বাচন হতে হবে। এ লক্ষ্যে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করছি। দাবি আদায়ে সব রাজনৈতিক দল ও গণতান্ত্রিক মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে দুর্বার আন্দোলন করা হবে। সে লক্ষ্যেই বিএনপি কাজ করছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী যুগান্তরকে বলেন, মহান স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে গত সোমবার লন্ডনে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অনেক বিষয়ে স্পষ্ট করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি নির্বাচন চায় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে, কোনো জাতীয় সরকারের অধীনে নয়। সেই নির্বাচনে বিএনপি জয়ী হলে সব গণতান্ত্রিক দল, শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদসহ সব পেশাজীবীকে নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করবে। যারা নির্বাচনে জিতবে, যারা জিতবে না কিন্তু গণতন্ত্র ও জনগণের পক্ষের প্ল্যাটফরমে এসে দাঁড়াবেন, সবাইকে একসঙ্গে নিয়ে আমরা জাতীয় সরকার গঠন করব। কারণ বিএনপি বিশ্বাস করে, এই অবৈধ সরকার দেশকে যে ঝঞ্জাল সৃষ্টি করেছে, তা যদি দূর করতে হয় নির্বাচনের পর দলমত নির্বিশেষে সবার সমন্বয়ের ভিত্তিতে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা প্রয়োজন।
রিজভী আরও বলেন, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক দল আছে যাদের কেউ কেউ সুযোগ খুঁজছে। বর্তমান সরকার তাদের লোভ দেখাচ্ছেন-আমার সঙ্গে আসো, নির্বাচন করো, তোমাদের বিরোধী দলে দিব। আজ যারা এই সিদ্ধান্ত নেবেন, তারা যতদিন বেছে থাকবেন আওয়ামী লীগের দালাল হয়ে বেছে থাকবেন। বিএনপির সঙ্গে কিছু কিছু বিষয়ে মতপার্থক্য থাকতে পারে। কেউ কেউ বলছে জাতীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চান। তাদের মধ্যে অনেকে আছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, যারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। একাত্তর সালে যেভাবে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন, আজ আবারও সময় এসেছে জনগণের পক্ষে, গণতন্ত্রের পক্ষে আপনারা দাঁড়ান। রাজপথেই ফয়সালা হবে।
সূত্র জানায়, ‘বিরোধী জোট’ গঠন ও আন্দোলনের লক্ষ্যে দুমাস ধরে সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। এসব রাজনৈতিক দলগুলো শীর্ষ নেতাদের মতামত ও নিরপেক্ষ সরকারের রূপরেখার খসড়ার ওপর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নির্দেশনা নিয়ে শিগগিরই দেশে ফেরার কথা রয়েছে টুকুর। এরপর রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের সম্মানে বিএনপির ইফতার পার্টিতে ‘নিরপেক্ষ সরকারের ফর্মুলা’ ও ‘বিরোধী জোট’ গঠনের বিষয়ে কিছু বার্তা দেওয়া হবে। আগামী ১২ এপ্রিল গুলশানের একটি হোটেলে কূটনীতিকদের সম্মানে ইফতার পার্টি আয়োজন করা হয়েছে। কিন্তু রাজনীতিকদের সম্মানে ইফতার পার্টির তারিখ এখনো ঠিক হয়নি। তবে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ওই ইফতারে আমন্ত্রণ জানাবে বিএনপি।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে একমঞ্চে আনতে তাদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। চূড়ান্ত কিছু হলে সময়মতো জানানো হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপর সিদ্ধান্ত এই সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। যেখানে বিএনপি এই সরকারের অধীনে নির্বাচনেই যাবে না, সেখানে আগামী নির্বাচনে কে প্রধানমন্ত্রী হবেন এসব কথা অযৌক্তিক। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হলেই না তখন এই প্রশ্ন আসবে।
প্রসঙ্গত, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবলিত বাংলাদেশের সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধন আইন, ১৯৯৬ সালের ২৬ মার্চ ষষ্ঠ সংসদের প্রথম অধিবেশনে ভোটে পাশ হয়। ২৮ মার্চ রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভের পর এটি আইনে পরিণত হয়। পরে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন সপ্তম ও অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে আবার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য শুরু হয় এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার সূচনা ঘটে। পরে ২০১১ সালের ১০ মে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলের রায় দেন। বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করা হয়। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পরবর্তী সংসদ বহাল থাকাবস্থায় ক্ষমতাসীন দলীয় সরকারের অধীন দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। দেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপির বর্জনের মধ্য দিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত হয়। একই প্রক্রিয়ায় একাদশ সংসদ নির্বাচন হলে বিএনপি তাতে অংশ নিলেও ভরাডুবি হয়। পরে এ নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ তোলে।