সম্পদের পাহাড় জেল সুপারের, কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও জমি

বাংলাদেশ

নিউজ ডেষ্ক- সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার শাহাজাহান আহমদ। বানিয়েছেন একাধিক বহুতল ভবন। কিনেছেন বিলাসবহুল ফ্ল্যাট ও জমি। তবে নিজ নামে তিনি কিছুই করেননি। সবাই করেছেন স্ত্রী বেগম নুর নাহার লোটাসের নামে। নির্ভরযোগ্য সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

সূত্র জানায়, কুমিল্লা কারাগারে একক আধিপত্য বিস্তার করে কয়েক কোটি টাকা লোপাট করার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এরমধ্যে রয়েছে কারাগারের পুকুরের মাছ বিক্রি, উৎপাদন বিভাগে উৎপাদিত পণ্যের টাকা আত্মসাৎ, টাকার বিনিময়ে কারারক্ষী নিয়োগ, বন্দি নির্যাতন করে অর্থ আদায়, কোয়ারেন্টিনে থাকা বন্দিদের অবৈধ সুবিধা প্রদান, কারা ক্যান্টিনে নগদে পণ্য বিক্রি করে লভ্যাংশ আত্মসাৎ, কারা হাসপাতালে সুস্থ লোককে অসুস্থ দেখিয়ে ভর্তি রেখে টাকা আদায়, সিট ও মোবাইল বাণিজ্য ইত্যাদি। কারাগারের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ক্ষমতার অপব্যবহার ও ঘুষ গ্রহণকে শাজাহান নিয়মে পরিণত করেছেন। কারাগারে মাদক ব্যবসার সুযোগ করে দিয়েছেন তিনি। ঠিকাদারদের দিয়েছেন কারা অভ্যন্তরে মানহীন খাবার সরবরাহের সুযোগ। এর মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। কারা অভ্যন্তরের মোবাইল বুথ আর ক্যান্টিন বাণিজ্যের মাধ্যমেও আদায় করেছেন কোটি টাকা। কর্মকর্তারা আরও অভিযোগ করেন, ২০২০ সালের নভেম্বরে কুমিল্লা কারাগারে যোগ দেন শাহাজাহান আহমদ। এরপর থেকেই চাহিদামতো টাকা না দিতে পারলেই বন্দিদের ওপর নেমে আসে নির্যাতনের খড়গ। বন্দি নির্যাতনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আদালতে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দি নির্যাতনের কয়েকটি ঘটনায় তার বিরুদ্ধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

এক কর্মকর্তা বলেন, বন্দিদের স্বজনদের কাছ থেকে অবৈধ সুবিধা নেওয়া, যাচাই-বাছাই না করে স্বজনদের দেখা করিয়ে দেওয়া এখন এ কারাগারে নিয়মিত ঘটনা। করোনাকালে বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের সাক্ষাৎ সরকারি নির্দেশে বন্ধ থাকলেও মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে সে সুযোগ দেয়া হয়েছে। কারাগারের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ দেখলেই এসব অভিযোগ প্রমাণিত হবে।

স্ত্রীর নামে যত সম্পদ: অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা ও টাঙ্গাইলে শাজাহানের স্ত্রী নুর নাহার লোটাসের নামে একাধিক বাড়ি, ফ্ল্যাট, গাড়ি ও কয়েকশ বিঘা কৃষি জমি রয়েছে। রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এইচ ব্লকের ২ নম্বর রোডের ৬৮২নং প্লটে চার ইউনিটের সাত তলা বাড়ি, মালিবাগ শাহী মসজিদ এলাকায় ২২২ নম্বর কাজী নিবেশ টাওয়ারের ৩ডি নম্বরে ২২০০ বর্গফুটের বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটির মালিকানা নুর নাহার লোটাসের নামে। টাঙ্গাইল সদরের শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ এলাকায় সাবালিয়া মোড়ে ‘বি’ ব্লকের ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের ৪তলা প্রতীতি টাওয়ার ও এর পাশের ১৩ নম্বর ভবনে রয়েছে দেড় কোটি টাকা দামের দুটি ফ্ল্যাট।

শাজাহানের বাবার পৈতৃক ভিটায় লোটাসের নামে তৈরি করা হচ্ছে ৬ কোটি ব্যয়ে ৫ তলা ডুপ্লেক্স বাড়ি। এ বাড়িটি নির্মাণাধীন। লোটাস ব্যবহার করেন ৪০ লাখ টাকা দামের হুন্দাই বেজেল ব্র্যান্ডের মেরুন রঙের আলিশান গাড়ি। যার নম্বর ঢাকা মেট্রো-গ ১৭-৪১৮৮। সূত্রের দাবি, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সরকারি তদন্ত সংস্থাকে ফাঁকি দিতেই এসব সম্পদের মালিক করা হয়েছে নুর নাহার লোটাসকে।

যত অভিযোগ : দায়িত্ব অবহেলার কারণে বিনা চিকিৎসায় বন্দি আলমগীর হোসেন (হাজতি নং ১১৬৭/২১) মৃত্যুর ঘটনায় তার বিরুদ্ধে তদন্ত চলমান রয়েছে। আলমগীরের স্ত্রী নাসিমা বেগমের অভিযোগের ভিত্তিতে কুমিল্লা কারাগারে তদন্ত করেন চট্টগ্রাম বিভাগের উপমহাপরিদর্শক একেএম ফজলুল হক। গত বছরের ১ নভেম্বর কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সিনিয়র জেল সুপার শাহাজাহান আহমেদের নামে মামলা করেন নাসিমা। নাসিমার দাবি, তার স্বামীকে কারাগারের মেডিকেল অফিসার তথা সিভিল সার্জন অফিসার হৃদরোগের উন্নত চিকিৎসার জন্য কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ বা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানোর পরামর্শপত্র দেন। কিন্তু সিনিয়র জেল সুপার এ বিষয়ে কর্ণপাত করেননি। বরং বিনা চিকিৎসায় কারাগারে সাধারণ ওয়ার্ডে আটকে রাখেন। ২২ দিন পর গত বছরের ৩১ মে তার স্বামী বিনা চিকিৎসায় মারা যান।

এর বিচার চেয়ে বাংলাদেশ মানবাধিকার কমিশনেও অভিযোগ করেন নাসিমা। মানবাধিকার কমিশন অভিযোগটি আমলে নিয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ঊর্ধ্বতন কারা কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানায়। এর ভিত্তিতেই তদন্তে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে আসেন কারা উপমহাপরিদর্শক একেএম ফজলুল হক। তিনি ঘটনার সত্যতা পান। কিন্তু এ বিষয়ে এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি শাজাহানের বিরুদ্ধে।

কিছুদিন আগে কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে বন্দি নির্যাতনের ছবি ও ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। কারা অধিদফতর সূত্রে জানা যায়, ভারতের পশ্চিম ত্রিপুরা রাজ্যের দুর্গাপুর গ্রামের আবদু মিয়ার ছেলে শাহজাহান বিলাস ডাকাতি ও হত্যা মামলার ৫৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত হয়ে কুমিল্লা কারাগারে ২৬ বছর ধরে বন্দি ছিলেন। গত বছর ১২ পিস ইয়াবা, এক পুরিয়া গাঁজা, নগদ ৬০০ টাকাসহ কারারক্ষীদের হাতে ধরা পড়েন। পরে কারা অভ্যন্তরে কেস টেবিলের সামনে জিজ্ঞাসাবাদ করেন সিনিয়র জেল সুপার শাহাজাহান। একপর্যায়ে বন্দি বিলাসের দুই হাত পিঠমোড়া করে বেঁধে মাটিতে ফেলে বেধড়ক পেটানো হয়। নির্যাতনের ফলে উক্ত বন্দি অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে কারা হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হয়। পরে আবার সেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগ ও কারা অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের নজরে আসে। পরে কারা অধিদপ্তরের নির্দেশে এ ঘটনায় তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এর অগ্রগতির তথ্য জানা যায়নি।

কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার ডুমুরিয়া গ্রামের মোসলেম মিয়া কারাগারে বিনা চিকিৎসায় মারা যান বলে অভিযোগ করেন তার ভাই ইউসুফ জামিল মাসুম। মাসুম বাদী হয়ে গত বছরের ১৫ নভেম্বর কুমিল্লা অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করেন। এই মামলায় কারাগারের শাহজাহান আহমেদ, জেলার মো. আসাদুর রহমান, ডেপুটি জেলার আবদুস সোবাহান ও অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে আসামি করা হয়। বর্তমানে মামলাটিও তদন্তাধীন ।

গত বছরের ১৮ অক্টোবর সিনিয়র জেল সুপার মো. শাহাজাহান আহমেদ ও সহকারী প্রধান কারারক্ষী শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে মামলা করেন নগরীর মুরাদপুর এলাকার মৃত সেলিম মিয়ার স্ত্রী বেবী আক্তার। তিনি বলেন, তার ছেলে রাসেল মিয়া ২০১২ সাল থেকে কারাগারে আটক ছিলেন। গত বছরের ৬ জুন আসামিরা কারা অভ্যন্তরে তার ছেলেকে তুচ্ছ ঘটনায় বেধড়ক পিটিয়ে জখমসহ দুটি আঙুলের হাড় ভেঙে ফেলে। এ ঘটনায় আদালতে মামলা হলে সিভিল সার্জনকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি হয়। কমিটি ঘটনার সত্যতা পেয়ে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করে।

কারাভোগ করা সুজন মিয়া যুগান্তরকে জানান, গত বছরের ৮ ডিসেম্বর কুমিল্লা কেন্দ্রীয় কারাগারে হাত-পা বেঁধে আমাকে নির্যাতন ও জখম করা হয়। এ ঘটনায় চলতি বছরের ১৩ জানুয়ারি কুমিল্লার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করি। এ মামলায় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. শাহাজাহান আহমেদ, জেলার আসাদুর রহমান, প্রধান কারারক্ষী আনসার আলীকে আসামি করি। মামলাটির তদন্ত চলমান আছে।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহাজাহান আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আমার ও আমার স্ত্রীর নামে কোনো সম্পদ নেই। একটি মহল আমার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করছে। কোনো অভিযোগের সত্যতা নেই। পরে তিনি ফোন করে এ বিষয়ে কোনো সংবাদ প্রকাশ না করার জন্য এ প্রতিবেদককে অনুরোধ জানান।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *