নিউজ ডেষ্ক- Here the land ends and sea begins. পর্তুগিজ কবি লুইস কামেসের ভাষায় এটি সেই জায়গা যেখানে ভূমির শেষ এবং সমুদ্র শুরু। এপারে ইউরোপ, ওপারে আমেরিকা। সে কথায় পরে আসছি। ও হ্যাঁ, যা বলছিলাম। লিসবনের রসিও থেকে রওনা হয়ে পথে বেশ কিছু স্টেশনে যাত্রা বিরতি দিয়ে সিন্ত্রার মাটিতে যখন পা রাখলাম ততক্ষণে ঘড়ির কাঁটা ১টা ছুঁই ছুঁই। ডে ট্যুর শুরু করার খুব আদর্শ সময় না হলেও, গ্রীষ্মের এ সময় ইউরোপের অধিকাংশ শহরে সন্ধ্যা হয় ৯টায়, জেনে একটু আশ্বস্ত হলাম।
আমাদের আজকের ট্যুর প্ল্যানে আছে ইউরোপের পশ্চিম দিকের সর্বশেষ বিন্দু কাবো দ্য রোকা, মুরিশ স্মৃতিবিজড়িত রোমান্টিক পেনা প্যালেস আর সময় থাকলে সমুদ্র তীরবর্তী শহর কাসকাইস। এর মধ্যে কাবো দ্য রোকা যেহেতু একটু দূরে তাই সেখান থেকেই ট্যুর শুরুর সিদ্ধান্ত নিলাম। একটা ক্যাফেতে হালকা কিছু স্ন্যাকস সদগতি করার ফাঁকে স্থানীয় এক লোকের কাছ থেকে সিন্ত্রা সম্পর্কে কিছু তথ্য নিয়ে নিলাম।
ইউরোপের পর্তুগালের রাজধানী লিসবন থেকে চল্লিশ কিলোমিটার দূরে সিন্ত্রা কাসতেলো। ধারণা করা হয় ১১০০ সালের দিকে সিন্ত্রার যাত্রা শুরু। অনেক ঐতিহাসিকের মতে সিন্ত্রার রমরমা অবস্থা আসলে পর্তুগালের মুসলমান শাসকদের হাত ধরেই শুরু হয়। যখন মুসলমান রাজ্যের অধীনে পর্তুগালে শাসন চলছিল তখন মুসলমান রাজাগণ এই ক্যাসেলগুলো তৈরি করেন। আর এখান থেকেই প্রাদেশিক রাজাগণ তাদের রাজ্য পরিচালনা করতেন। যুগে যুগে মানুষ এসেছে আবার চলেও গেছে, কিন্তু ইতিহাসের পাতায় তাদের কীর্তির মাধ্যমে পদচিহ্ন এঁকে দিয়ে গেছে। সেইরকমই এক পদচিহ্নের পথ ধরে আমরা আজ হাজির হয়েছি এই ঐতিহাসিক নগরীতে। শৈল্পিক আর ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসেবে সিন্ত্রা বিশ্বের তাবৎ পর্যটক মহলে বেশ পরিচিত নাম। প্রতি বছর এখানে বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে হাজার হাজার পর্যটকরা ভিড় জমান এই ঐতিহাসিক নগরীর রূপসুধা আস্বাদন করতে। আমরা আর বাদ যাই কেন।
লিসবনে এসেছি ছয় দিন হয়ে গেছে। গতকালই কনফারেন্সে আমাদের কার্যক্রমের সমাপ্তি হয়েছে। আজকে অনেকেই দেশের ফ্লাইট ধরবে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট, তাই বেশিরভাগই ব্যাস্ত শেষ মুহূর্তের ব্যাগ গোছানোয়। অনেকের এখনো কেনাকাটা বাকি, তাই কয়েকজন দেখি এই সাত সকালেই শপিং মলের উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেলেন। আমার এত তারা নেই। আমার হাতে যেহেতু এখনো বেশকয়েকটা দিন বাকি, তাই আমি ধীরে-সুস্থে নাস্তা সারলাম। এই হোটেলে আমার আগামীকাল পর্যন্ত বুকিং আছে। এরপর অন্য হোটেল দেখতে হবে। খালুকে আগেই বলে রেখেছি। তিনি কাল রাতেই আস্বস্ত করেছেন।
বাঙালিপাড়ার কাছেই একটা সস্তা লজে রুম পাওয়া গেছে। এখানে তুলনামূলক কম মূল্যের হোটেলগুলিকে পেনাসিও বলা হয়। আমার জন্যও এই ধরনেরই কিছু একটার এন্তেজাম করা হয়েছে বলে আন্দাজ করলাম। এমনিতে একা ট্রাভেল করলে আমি সাধারাণত স্টুডেন্টস হোস্টেল বা ডরমিটরি ইউস করি। কারণ ঘুরতে বের হলে শুধু রাতটাই হোটেলে থাকা হয়, খামাখা এত টাকা খরচ করার কোনো মানেই হয় না। বরঞ্চ সেই টাকা অন্য কোন স্থানে যেতে ব্যাবহার করা যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হবে। এই ধরুন এই বর্জেস চিয়াদো হোটেলের প্রতি রাতের রুম ভাড়া প্রায় ৮০ থেকে ১০০ ইউরোর মতো, সেখানে পরের বছর আমি প্রাগে এক স্টুডেন্ট হোস্টেলে মাত্র ৭ ইউরোয় রাত কাটিয়েছি। কাল রাতে কনফারেন্স থেকে ফেরার পর খালু এসেছিল হোটেলে। আজ সকালে আমাদের এখান থেকে ট্রেনে করে ইউরোপের সর্বশেষ বিন্দু কাবো দ্য রোকা আর সিন্ট্রা যাওয়ার কথা। আর হাতে সময় থাকলে কাসকাইস ও ঘুরে আসার প্ল্যান।
আমি সকাল থেকেই রেডি হয়ে রইলাম। কথা ছিল সাড়ে ১০টায় আমরা রসিও রেলস্টেশনে মিট করব। আমি আগেই একটু এক্সসাইটেড হয়ে রসিও চলে এলাম। হাতে যেহেতু সময় আছে তাই আজ একটু সময় নিয়েই রসিও স্কোয়ারের মূর্তিগুলোর আর এর চারপাশের নিউ ম্যানুলাইন এবং নিউ ক্ল্যাসিক্যাল রীতিতে বানানো স্থাপনাগুলোর ছবি তুললাম। সময় পার হয়ে গেল অনেকটা, কিন্তু খালু বা মামা কারও দেখা নেই। অনেকবার ফোন করার পর ফোন ধরলেন একজন। মাত্র ঘুম থেকে উঠেছেন। কী আর করা তাদের তাগাদা দিয়ে আমি ব্যাস্ত হয়ে রইলাম আমার ক্যামেরা নিয়ে। রসিও স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের খোঁজ করে এলাম এক ফাঁকে। এখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় সিন্ট্রার উদ্দেশ্যে ট্রেন ছেড়ে যায়। অবশেষে খালু, মামা আর তার সঙ্গী ফয়সাল মামাকে নিয়ে সিন্ত্রার ট্রেন ধরতে ধরতে ১২ টা বেজে গেল। ১ ঘণ্টার ট্রেন জার্নি দেখতে দেখতেই কেটে গেল।
মাদেইরা ও আজোরেস দ্বীপপুঞ্জকে গণনায় ধরে পর্তুগালের মোট আয়তন ৯২,৩৫৫ বর্গকিলোমিটার। পর্তুগালের মূল ভূখণ্ড আইবেরীয় উপদ্বীপের পশ্চিমের এক-ষষ্ঠাংশ এলাকাজুড়ে অবস্থিত। পর্তুগালের পশ্চিমে দৈর্ঘ্য বরাবর আটলান্টিক মহাসাগর, পূর্বে স্পেনীয় সীমান্ত। প্রায় গোটা স্পেনজুড়ে মেসেতা সেন্ত্রাল নামের যে মালভূমি অবস্থিত, তারই পশ্চিম ঢাল পর্তুগালের পূর্বাঞ্চল গঠন করেছে। পর্তুগালের উত্তরভাগ রুক্ষ ও পাহাড়ি। উত্তরে মেসেতা সেন্ত্রালের প্রান্ত থেকে অনেকগুলি পর্বত গোটা উত্তরাঞ্চলজুড়ে প্রসারিত। এগুলো ১২০০ মিটারের ও বেশি উচ্চতাবিশিষ্ট হতে পারে। পশ্চিমে ও দক্ষিণে পাহাড়গুলি ধীরে ধীরে নিচে নেমে একটি বড় উপকূলীয় সমভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই সমভূমিটিতে ব্যাপক কৃষিকাজ সম্পন্ন হয় এবং এখানে নগরায়নের হার ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। পর্তুগালের দুই বৃহত্তম শহর লিসবন ও পোর্তু এখানেই অবস্থিত।
পর্তুগালের মধ্যভাগে উপকূল থেকে ভেতরে সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি রয়েছে। এখানে পর্তুগালের সর্বোচ্চ পর্বত মালহাঁউ দ্য এস্ত্রেলা (Malhão de Estrela) অবস্থিত; এর উচ্চতা ১,৯৯১ মিটার। মধ্য পর্তুগালের পর্বতগুলি দক্ষিণ-পশ্চিমে নেমে গিয়ে সিন্ত্রা শহরের কাছে পাহাড়ের সাথে মিলে গেছে। তাগুস নদীর দক্ষিণে মূলত ঢেউখেলানো সমভূমি যা আলেঁতেজু অঞ্চল নামে পরিচিত। পর্তুগালের একেবারে দক্ষিণে অঞ্চলটির নাম আলগার্ভি; এটি আলেঁতেজুর সমভূমিগুলো থেকে সের্রা দি মোঁচিকি পর্বতশ্রেণী দ্বারা বিচ্ছিন্ন। তেজু বা তাগুস, দৌরু, মিনিউ পর্তুগালের তিনটি প্রধান নদী। আমরা আজ এসেছি সিন্ত্রা শহরেই আর এখান থেকেই কাবো দ্য রোকা ঘুরে আসার প্ল্যান।
রেস্টুরেন্ট থেকে সামান্য হাঁটতেই কাবো দ্য রোকা যাওয়ার বাসস্ট্যান্ড পেয়ে গেলাম। এখান থেকে প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় বাস ছেড়ে যাচ্ছে। গাড়ি ভাড়া করে না গেলে এই বাসেই আবার আপনাকে ফিরতে হবে। তাই বাসে উঠেই ফেরার লাস্ট বাসের সময়টা জেনে নিবেন, অন্যথায় পকেটের বেশ কিছু ইউরো মাশুল দিতে হতে পারে। তার ওপর এই রকম একটা রিমোট যায়গায় সবসময় যে ট্যাক্সি বা গাড়ি পাবেন তারও কোন নিশ্চয়তা নেই। কিছুক্ষণ আগেই একটা বাস ছেড়ে গেছে আমাদের তাই কিছুটা সময় অপেক্ষা করতে হলো। কাছে পিঠে যে কোথাও ঘুরে আসবো তারও উপায় নেই, আবার যদি বাস মিস করে বসি। এই ভয়ে টিকিট কেটে বাস স্ট্যান্ডেই বসে রইলাম। বাস আসার সুযোগে সিন্ত্রা সম্পর্কে খালুর কাছ থেকে জেনে নিচ্ছিলাম। খালু এর আগেও বেশ কয়েকবারই এখানে এসেছেন, তবে শুভ মামা আর ফয়সাল মামার এটাই প্রথম সিন্ত্রা সফর।
সিন্ত্রা: পর্তুগালের এই ছোট শহরটি তার চমৎকার আবহাওয়া তথা পর্তুগালের অন্যান্য জায়গার তুলনায় একটু ঠাণ্ডা বলে পর্তুগালের এক অন্যতম টুরিস্ট আকর্ষণ। লিসবন থেকে ট্রেনে মাত্র ত্রিশ মিনিটেই এই সুন্দর শহরে পৌঁছে যাওয়া যায়। প্রাচীন সময়ে মুরিশ থেকে শুরু করে, পর্তুগালের রাজপরিবার এবং অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি এই জায়গায় প্রাসাদ থেকে শুরু করে বিশাল বাড়ি তৈরি করেছিলেন। ছবির মতো সাজানো এই রূপকথার শহরটি পর্তুগালের পর্যটনের কপালে এক রাজ তিলক। সবুজের চাদর দিয়ে মোড়ানো শান্ত এক শহর আর তার মধ্যস্থলে মধ্যযুগীয় ন্যাশনাল প্যালেস ঘিরে টুরিস্টের ভিড় এই শহরের জীবনযাপনের এক অঙ্গ বলা যায়।
রাজধানীর নিকটবর্তী সিন্ট্রা শহর তার শীতল জলবায়ু এবং পাহাড়ি সৌন্দর্যের জন্য সর্বদা লিসবনের শাসকগোষ্ঠীর অত্যন্ত প্রিয় ছিল, তারা মুসলমান শাসক হোক বা খ্রিস্টান। শহরের বাইরে মুসলিম শাসকরা বিনোদনের জন্য যে প্রাসাদগুলো নির্মাণ করেছিলেন, সেগুলো এখন আর নেই। পরিবর্তে রয়েছে তাদের অবশিষ্টাংশের উপরে খ্রিস্টান অভিজাত ও রাজবংশের নিদর্শন। তবে তাদের মধ্যে অধিকাংশের এই অঞ্চলের মুসলিম ঐতিহ্যের জন্য কিছু দুর্বলতা ছিল। ফলস্বরূপ, সিন্ট্রার মুরিশ যুগ-পরবর্তী প্রাসাদগুলো দেখলেও দর্শকরা সেখানে সপ্তদশ ও অষ্টদশ শতকের রোমান্টিক মুরিশ শিল্পকীর্তির পুনর্ভাবনার ছায়া দেখতে পাবেন। তার আদর্শ উদাহরণ হল পেনা প্রাসাদ। এটি পর্তুগালের সিন্ট্রা শহরের সাও পেদ্রো ডি পেনাফেরিমে অবস্থিত।
পর্তুগালের উনিশ শতাব্দীর রোমান্টিক আর্কিটেকচারের মনুমেন্টের মধ্যে অন্তত দশটা জাতীয় মনুমেন্টের ঠিকানা এই শহর। তাই লিসবনে পা রাখা ট্যুরিস্টরা এখানে পা রাখার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চায় না। প্রাচীন মুরিশ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ থেকে শুরু করে, পর্তুগিজ রাজার অলংকৃত প্রাসাদ, সিন্ত্রা শহর ও একে ঘিরে সবুজ পাহাড় অঞ্চল, সবই ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটের অন্তর্গত। এখানেই আপনি খুঁজে পাবেন প্রাচীন আর্টেসিয়ান কূপ, যে কথা মাধ্যমিকের ভূগোল বইতে পড়েছি, আজ তা স্বচক্ষে দেখতে পাবো, ভাবতেই শিরদাঁড়া দিয়ে শিহরণের স্রোত নেমে গেল। সিন্ত্রাতেও মানব বসতির ইতিহাস অনেক পুরনো, অনেক নিদর্শন পাওয়া গ্যাছে যেগুলো দেখে ধারণা করা হয় প্রাক প্রস্তরযুগ হতে এখানে মানুষের বসবাস। স্বাভাবিক কারণেই অত প্রাচীন যুগের বাড়িঘর টিকে নেই, তবে মধ্যযুগীয় অনেক দুর্গ এখনো মাথা উঁচু করে রেখেছে সিন্ত্রাতে।
বাসস্ট্যান্ড থেকেই দেখা যাচ্ছিল একটা মুরিশ ক্যাসেলের ছাদের অংশ ভেদ করে উপরের দিকে উঠে যাওয়া দুইটি চিমনি। এই ক্যাসেলটা বোধহয় সিন্ত্রার সিগনেচার আইকন, কারণ সিন্ত্রা সম্পর্কিত বেশ কয়েকটা আর্টিকেলে এই ছবিটা দেখেছি। এখন আর সেই বিচার করার সময় নেই, কারণ আমাদের বাস চলে এসেছে। বাসে উঠে পড়লাম। বাসে আমরা ছাড়াও আরও জনা দশেক ট্যুরিস্ট আছে। জানালার ধারে সিট খুঁজে নিতে খুব একটা সময় লাগলো না। অল্প সময়েই আমাদের টিকেট চেক করে বাস ছেড়ে দিলেন ড্রাইভার। আমাদের দেশের মতো এখানে বাসে কোনো কনডাক্টর নেই। এই রূটে আর কোনো স্টপেজও নেই। এখান থেকে প্রায় ৩০ মিনিটের যাত্রা সরাসরি আমাদের পৌঁছে দিল ইউরোপের শেষ বিন্দুতে। যে আশায় জানালার পাশে বসেছিলাম, তা খুব একটা সফল হলো না। রাস্তার দুই পাশেই ঘন ঝোপ আর গাছের সারি, এছাড়া কোনো উল্লেখযোগ্য স্থাপনা চোখে পড়ল না। বাস থেকে নামতেই চোখে পড়ল একটা লাইট হাউসের দিকে।
কাবো দ্য রোকা :সাগর আর আকাশের মিতালি আর নীল জলরাশিতে সূর্যের কিরণের ঝিকিমিকি, আর একদিকে আকাশে হেলান দেয়া সুঊচ্চ সবুজ সিন্ত্রা-কাসকাইস পর্বত রেঞ্জ, সবমিলিয়ে স্বর্গের দ্বারে যেন এসে পড়লাম। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে পর্তুগাল তথা ইউরোপের পশ্চিমের শেষ বিন্দুতে পা রাখলাম আমরা। কাবো দ্য রোকা বা কেপ রোকা, ইউরোপের শেষ প্রান্ত নামে পরিচিত আটলান্টিক পাড়ের এই দর্শনীয় স্থানটি অসংখ্য ভ্রমণপিপাসুদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু। সাগর আর পাহাড়ের মনোমুগ্ধকর সৌন্দর্য উপভোগ করতে স্থানীয়দের পাশাপাশি ইউরোপ বা আমেরিকায় থাকা প্রবাসী বাংলাদেশিরাও ছুটে আসেন এখানে। সাগর আর আকাশ যেখানে মিলেমিশে একাকার। নীল জলরাশিতে সূর্যের কিরণ সে সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দিয়েছে আরও বহুগুণ। অন্যপাশে সুউচ্চ সবুজ পাহাড় যেন দিচ্ছে স্বর্গের হাতছানি। চমৎকার রৌদ্রোজ্জ্বল আবহাওয়ায় এমন সৌন্দর্য উপভোগ করতে ‘ইউরোপের শেষ প্রান্ত’ নামে পরিচিত ‘কাবো দ্য রোকা’ মুখর পর্যটকদের পদচারণায়।
রাজধানী লিসবন থেকে প্রায় ৪২ কিমি দূরে অবস্থিত আটলান্টিক মহাসাগরের কোল ঘেঁষে ১৪০ মিটার সুউচ্চ পাহাড়ের উপর অবস্থান এই জায়গার। মূলত ক্যাবো দ্য রোকা হলো একটি চূড়া। পর্তুগালের মূল ভূখণ্ডে সিন্ত্রা পর্বতমালার পশ্চিমতম বিন্দু এটি। দেশটির রাজধানী লিসবনের দক্ষিণ-পশ্চিমে আজোইয়ার কাছাকাছি সিন্ত্রা পৌরসভায় এর অবস্থান। এখানেই রয়েছে প্রায় তিনশ বছরের পুরাতন দৃষ্টিনন্দন বাতিঘর। পর্তুগালের বাইরেরও লাখো ভ্রমণপিপাসু মানুষের পর্তুগাল ভ্রমণের অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে এই কাবো দ্য রোকা। পর্তুগিজ কবি লুইস কামেস এই স্থানের কথাই উল্লেখ করেছিলেন। তার বক্ত্যবের সার্থক বর্ণনা আজ চাক্ষুষ করলাম। ১৪শ শতকের শেষ পর্যন্তও মানুষের ধারণা ছিল এটাই বোধহয় পৃথিবীর শেষপ্রান্ত। হাঁটতে চলে এলাম এর প্রান্ত দেশে। আটলান্টিকের সুনীল পানি আছড়ে পড়ছে এর পাথুরে সৈকতে। সে এক দৃষ্টিনন্দন শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি। এই অনুভূতি কী লেখায় প্রকাশযোগ্য। এখানে আসলে ইচ্ছা হবে আহা বাকি জীবনটা যদি এখানেই কাটিয়ে দিতে পারতাম। আটলান্টিক মহাসাগর তীরবর্তী ক্যাবো দ্য রোকা হলো ইউরোপের সবচেয়ে পশ্চিমের স্থলবিশেষ।
ইউরোপ ও এশিয়ার সমষ্টিগত মহাদেশ ইউরেশিয়া বলয়ের ভেতরে এরপর আর কোনো স্থলভাগ নেই। এর কয়েক হাজার মাইলজুড়ে শুধু আটলান্টিক মহাসাগরের জলরাশি। এরপর থেকে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের যাত্রা শুরু। আটলান্টিক মহাসাগরের সুউচ্চ ঢেউ এবং নীল জলরাশি আর সেই সঙ্গে সিন্ত্রা পর্বতমালার নয়নাভিরাম দৃশ্য সহজেই মনকে উদাস করে দেয়। সিন্ত্রা থেকে মাত্র ১৮ কিমি দূরে এই নয়ানাভিরাম সৌন্দর্যের আধার এই ট্যুরিস্ট স্পট, তাই কোন ট্যুরিস্টই সিন্ত্রা এসে এই সৌন্দর্য উপভোগের সুযোগটা হাতছাড়া করেন না। এখানে একটা পাথরে রোটারি ক্লাবের একটা মনোগ্রাম অঙ্কিত যেটিতে লেখা আছে— “যেখানে ভূমির শেষ, আর সমুদ্রের শুরু”।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায় প্রায় তিনশ বছর পূর্বে এখানে একটি দুর্গ ছিল, যেটি লিসবন বন্দরে প্রবেশের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। যদিও বর্তমানে এই দুর্গের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলাম না, তবে এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমুদ্রের পাড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা লাইট হাউসের সৌন্দর্য হতাশ করবে না কাউকে, এ কথা গ্যারান্টি দিয়ে বলা যায়। পাথরের একটা খাজে পা ঠেকিয়ে বসে বসে উপভোগ করছিলাম আটলান্টিকের সৌন্দর্য। কেমন একটা ভেজা ভেজা অনুভুতির বাতাস ছুয়ে যাচ্ছিল সারা শরীরকে আর মুগ্ধতার পারদ চড়ছিল খুব দ্রুতই। এখানে বসে বসে সমুদ্রের ঢেউ ভাঙ্গা দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল সুচিত্রা ভট্টাচার্জির উক্তি “যেই ঢেউটা সমুদ্রে যায়, সেই ঢেউটাই কি আবার ফিরে”।
আসলেই কি ফিরে, না একবার গেলে চিরতরে হারিয়ে যায়। সেই প্রশ্নের উত্তর না হয় পাঠক আপনার ওপরই রইল। মুগদ্ধতার পরশ অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। হঠাৎ করেই কোঠা থেকে যেন এক পশলা শীতল বাতাস বইতে শুরু করল। সেই বাতাস এতই তীব্রে যে বেশিক্ষণ পাথরের উপর বসে থাকা নিরাপদ মনে হলো না। এর সাথে সাথেই চারিদিক ঘন মেঘে ঢেকে গেল আর তার পরপরই শুরু বৃষ্টি। কী আর করা, দৌড়ে কোনোরকমে লাইট হাউসের ভিতরে অবস্থান নিলাম। ভিতরটা এখন একটা ভিজিটর সেন্টার।
ক্যাবো দ্য রোকায় পৌঁছানোর পর চাইলে সাড়ে ১১ ইউরোর বিনিময়ে একটি সনদ সংগ্রহ করতে পারেন। আমি প্রথমে সনদ নিতে না চাইলেও খালুর জোরাজুরিতে নিতে বাধ্য হলাম। যথারীতি বিলটা খালুই মিটিয়েছিল। জানি না কখনও এই ভালোবাসাগুলোর মূল্য চুকাতে পারবো কিনা। জানি ভালোবাসার কোনো মূল্য হয় না, তারপরও আমার এ ক্ষুদ্র জীবনে এত উজার করা ভালোবাসা পেয়েছি যে, মাঝে মাঝে ভাবতেই ভয় হয় আমি কি পারব সবার প্রত্যাশার চাপ মেটাতে। বৃষ্টি থামতেই এখানে আর খুব বেশি সময় ব্যায় না করে ফিরতি বাসে চেপে বসলাম। এবার গন্তব্য সিন্ত্রার পেনা প্যালেস আর মুরিশ ক্যাসেল।
আবার সিন্ত্রায়: আটলান্টিকের সুনীল জলরাশির একটু ছোঁয়া পেয়ে কেমন একটা মুগ্ধতার আবেশ এখনো ছড়িয়ে রয়েছে তনুমনে। সেই মুগ্ধতার রেশ মিলিয়ে যেতে না যেতেই ট্যুরিস্ট বাস আমাদের নামিয়ে দিল সিন্ত্রা শহরে। এখান থেকে বাস বদল করে এবার আমরা ঐতিহাসিক পেনা প্যালেসের অভিমুখে।
কোনো এক রূপকথার বই থেকে উঠে আসা নিঝুম শান্ত সেই ছোট্ট শহরটির প্রেক্ষাপটে, ঘন সবুজ সিন্ত্রা পাহাড়ের গায়ে তখনো আটকে ছিল দলছুট মেঘের দল, আর ধূসর ভেজা দিনের সঙ্গে মানানসই ছিল সূর্য আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। পর্তুগালের ঐতিহাসিক রূপকথার মতো সুন্দর শহরের সেই সবুজ ধূসর দিনটি এখনো স্মৃতপটে অম্লান। সিন্ত্রার ঐতিহাসিক সিটি সেন্টারের পাথরে বাঁধানো সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে সম্পূর্ণ এক অন্য সংস্কৃতির জীবনযাপনের টিজার দেখতে পেলাম। মনে হলো যেন কোন রূপকথার রাজ্যে এসে পড়েছি। রাস্তার দুই পাশে আকাশছোঁয়া গাছ আর তার ফাঁক দিয়ে আসা সূর্যের কিরণে গথিক স্টাইলে তৈরি ন্যাশনাল প্যালেস বা টাউন প্যালেসকে মনে হচ্ছিল কোণ স্বর্গোদ্যান। এই বুঝি ব্যালকনি থেকে রাজকন্যা তার লম্বা চুলের বেনি ঝুলিয়ে দিবে। সেই বেনি ধরে উঠে যাওয়ার জন্যই সাত সমুদ্র তেরো নদী পাড়ি দিয়ে সেই সুদূর বঙ্গোপসাগরের কোল থেকে পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে ছুটে এসেছি আমি।
ধ্যান ভাঙল খালুর ডাকে। আমাদের বাস চলে এসেছে। আমার ইচ্ছা ছিল হেঁটেই পাড়ি দিব পাহাড়ি পথটুকু আর কল্পনায়ই না হয় রাজপুত্রের ভূমিকায় অভিনয়ের সুযোগ তো আর বারবার আসবে না। পঙ্খীরাজ ঘোড়ার বদলে আমার বাহন এখন ইঞ্জিনচালিত বাস। বাস এবার পাহাড়ি পথ ধরে উঠতে শুরু করল। বেশ কিছুটা পথ অতিক্রমের পর আমাদের আটকে পড়তে হলো বিপরীতমুখী ট্রাফিকের চাপে। বেশ খানিকটা সময় এখানে বসে থেকে অবশেষে বাস থেকে নেমে বাকি পথটুকু হেঁটেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের দেখাদেখি বাসের বাকি ট্যুরিস্টরাও দেখি নেমে এলো।
হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল নানা স্থাপত্য। তার মধ্যে সকালে নিচের বাসস্ট্যান্ড থেকে দেখা ডাবল চিমনির সেই মুরিশ ক্যাসেলও আছে। দেখে মনে হচ্ছে স্থাপত্য, ঐতিহাসিকতা, রূপকথা, কল্পনা, গল্প, কুয়াশা, মেঘ ও বৃষ্টি সব যেন মিলেমিশে এক হয়ে আছে এই মুরিশ ক্যাসেলে। এ যেন রূপকথার সেই নগরী, যে নগরীর গল্প যুগে যুগে কবি আর লেখকরা তাদের কল্পনার রঙে রাঙিয়েছেন। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথ দিয়ে হেঁটে আমরা যে প্যালেসে এসে পৌঁছালাম এটি আদতে প্যালাসিও ন্যাছোনাল জি সিন্ত্রা বা বা প্যালেস অফ সিন্ত্রা বা সিন্ত্রা ন্যাশনাল প্যালেস। প্যালেস অফ সিন্ত্রাও ইউনেসকো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। মধ্যযুগে ইউরোপের যে সমস্ত জায়গায় মুসলিম সম্রাজ্যের আধিপত্য বিস্তার হয়েছিল সিন্ত্রাও তার মধ্যে পড়ে।
বর্তমানে প্যালেস অব সিন্ত্রা যেখানে সেখানে ছিল একটি মুসলিম দুর্গ, সেই মুসলিম দুর্গকেই ধ্বংস করে সেই জায়গায় নির্মাণ করা হয়েছে প্যালেস অব সিন্ত্রা। প্যালেস অফ সিন্ত্রা এর সব থেকে সুন্দর জায়গা এর পেছনের দিকটা, ওখান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়। পাহাড়ের গা বেয়ে দুর্গ প্রাচীরের পাশ দিয়ে নির্মিত পায়েচলা পথটি যেমন অসম্ভব সুন্দর, তেমনি উত্তেজনাপূর্ণ। খুব সাবধানে পা ফেলে উঠতে হচ্ছিল। যেতে যেতে চোখে পড়ল সাধারণ মুসলিম নাগরিকদের বাসস্থান, দুই মুখ খোলা প্রাকৃতিক গুহায় বসবার ব্যবস্থা, দুর্গের নকশা, ছোট্ট একটা মিউজিয়াম যেখানে মুসলিম সময়ের তৈজসপত্র থেকে শুরু করে হাতিয়ার, অলঙ্কারসহ নানা কিছু। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম আর অনুভব করছিলাম অতীত হয়ে যাওয়া মুসলিম সাম্রাজ্যের শৈর্যবীর্যের কথা।
এখান থেকে সামান্য একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম আমাদের আজকের মুখ্য গন্তব্য পেনা প্যালেসের দোরগোড়ায়। চতুর্দশ শতাব্দী থেকেই পেনা প্রাসাদটি পর্তুগালের রাজপরিবারের গ্রীষ্মকালীন বাসভবন হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। রোদ ঝলমল দিনে লিসবন শহর থেকেও সহজে দেখা যায়। এটা পর্তুগালের জাতীয় স্মৃতিসৌধ এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর রোমান্টিসিজমের এক প্রধান অভিব্যক্তি হয়ে বিশ্বের বুকে আজও দাঁড়িয়ে আছে। গেট থেকে টিকিট কেটে ভিতরে ঢুকতে হলো। এখান থেকে প্যালেস দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু এটাও একটা পাহাড়ের ওপর। এখনো বেশ খানিকটা হেটে উঠলে তবেই প্রাসাদের অলিন্দে পৌঁছতে পারা যাবে। এখান থেকে আপনি চাইলে পায়ে হেঁটে উপরে উঠতে পারেন অথবা ৫ ইউরোর টিকিট করে ছোট ছোট বাস সার্ভিস ব্যবহার করে উপরে উঠতে পারেন। যেখান থেকে রাস্তা শুরু হয়েছে তার চার পাশটা খুব সুন্দর বাগান দিয়ে ঘেরা। জাপানি স্টাইলে বাগানের মধ্যে জলাধার, কৃত্রিম ঝর্ণা আর ছোট ছোট ব্রিজও আছে। জলাধারে নাম না জানা বিভিন্ন ফুলও ফুটে আছে। সব মিলিয়ে নৈসর্গিক একটা আবহ। পেনা পার্কটি এক বিশাল বনভূমি যা পুরোপুরি পেনা প্রাসাদকে ঘিরে প্রায় ২০০ হেক্টরের বেশি অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। প্রাসাদ হিসাবে ব্যাবহৃত হওয়ার সময়ে পার্কটি তৈরি করেছিলেন রাজা দ্বিতীয় ফার্দিনান্দ, যিনি ব্যারন ভন এসচওয়েজ এবং ব্যারন ভন ক্যাসলারকে এই কাজে সহায়তার জন্য নিয়োগ দিয়েছিলেন। রাজা বিভিন্ন, দূরবর্তী অঞ্চল থেকে গাছ লাগানোর আদেশ করেছিলেন, এর মধ্যে উত্তর আমেরিকার সিকোইয়া, লসনের সাইপ্রেস, ম্যাগনোলিয়া এবং ওয়েস্টার্ন রেডসিডার, চাইনিজ জিঙ্কগো, জাপানি ক্রিপটোমরিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের বিভিন্ন ধরনের ফার্ন এবং ট্রি ফার্ন অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা রানির ফার্ন গার্ডেনে কেন্দ্রীভূত ছিল। পার্কটিতে পথচলা ও সরু রাস্তাগুলোর একটি গোলকধাঁধা ব্যবস্থা রয়েছে যা পার্কজুড়ে প্রাসাদটিকে অনেকগুলো আকর্ষণীয় স্থানের সাথে সংযুক্ত করার পাশাপাশি দুটি গেটের সাথে সংযুক্ত করেছে। এরকমই একটি গেট দিয়ে আমরা প্রবেশ করলাম আর বের হয়েছিলাম আরেকটি গেট দিয়ে।
একবার ভাবলাম কি হবে এই ইট কাঠ পাথরের দুর্গ দেখে, তার চেয়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে এই বাগানেই সময়টা কাটাই। কিন্তু পেনা প্যালেস বলে কথা। ইউরোপের বিখ্যাত ১০টা প্যালেসের একটা এই পেনা প্যালেস। চাইলেই কি তাকে উপেক্ষা করা যায় না করা উচিত। রোম্যান্টিসিজমের আমলের এই প্রাসাদটিতে নানা ধরনের স্থাপত্যশৈলীর খেয়ালি সংমিশ্রণ। অনেকের তা দেখে ডিজনিল্যান্ডের কথা মনে পড়ে যায়। টুরিস্টরা কিন্তু সিন্ত্রা শহরের এ প্রাসাদটির প্রেমে পড়ে আছেন, যেমন প্রেমে মজেছি আমি। দুর্গ নামটি শুনলেই কেমন রহস্যময় আর ছমছমে একটি অনুভূতি খেলে যায় শরীর বেয়ে। দুর্গকে ঘিরে কত কল্পকাহিনী, কত ইতিহাস আর কত রহস্যময়তা। সেই রহস্যময়তার ঘোমটা উন্মোচন করতেই তো আমার পদার্পণ পর্তুগালের এই ঐতিহাসিক জনপদে। দুর্গ শুধু কল্পনা বা রুপকথার কোন বস্তু নয়, মানুষের হাতে তৈরি জাঁকজমকপূর্ণ সৌন্দর্য্যের নিদর্শন হিসাবে সেগুলো এখনো পৃথিবীর আনাচে-কানাচে বিদ্যমান। এগুলো সাধারণত মূল শহর থেকে দূরে তৈরি করা হয়েছে। বেশিরভাগ দুর্গগুলোই নজরকাড়া সবুজের সমারোহ দিয়ে পরিবেষ্টিত; যা দুর্গগুলোকে করেছে আরো আকর্ষণীয়। অল্প সময়েই বাস আমাদের পাথুরে রাস্তা বেয়ে বেশ খানিকটা এগিয়ে দিল।
এখান থেকেও বেশ কিছুটা পথ চড়াই-উতরাই করেই তবে পৌঁছতে পারলাম প্রাসাদের মূল অলিন্দে। বিশ্বের বেশ কিছু শহর ঘোরার সুবাদে অনেকগুলো বিখ্যাত প্রাসাদ বা দুর্গেই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। বেশিরভাগের মতোই এখানেও একটা ড্র-ব্রিজ দিয়ে মূল প্রাসাদ আলাদা করা। এমনটা করা হতো মূলত নিরপত্তার খাতিরে। ঢুকতেই একটা গেটের উপর চোখে পড়ল একটি পৌরাণিক ট্রাইটনের চিত্র, যা পৃথিবীর সৃষ্টির রূপকতার প্রতীক। মূল ফটক পেরিয়ে ঢুকতেই দুইটা এলসিডি স্ক্রিনে এই প্রাসাদের বিভিন্ন বর্ণনা আর তার বিভিন্ন চিত্র প্রদর্শিত হচ্ছিল সেখান থেকে কিছু তথ্য টুকে নিলাম ডায়রিতে পরে কাজে আসবে ভেবে। সেদিনের সেই সামান্য কাজ আজ দুর্দান্তভাবে কাজে দিচ্ছে।
সেরা দ্য সান্ত্রার টপ মোস্ট পয়েন্টে ১৬০০ শতকে নির্মিত একটা মন্সটারারির ধংসাবশেষের উপর ১৮৪০ থেকে ১৮৪৭ সালের মধ্যে নির্মিত হয় এই প্যালেস। এই প্যালেসকে গণ্য করা হয় পর্তুগালের সবচেয়ে সুন্দর স্থান হিসাবে, সেই সাথে ইউরোপের অন্যতম ফ্যাসিনেটিং প্লেস হিসাবেও এই প্যালেস সমাদৃত। পর্তুগালের রাজার সামার প্যালেস হিসাবে স্বীকৃত এই প্যালাসে মুরিশ, গথিক আর ম্যানুলাইন আর্কিটেকচারের এক রোমান্টিক মিশেল ঘটিয়েছেন বিখ্যাত জার্মান আর্কিটেক্ট ব্যারন ভন এসউইজ। রোমান্টিক স্টাইল পুনর্নির্মাণের কমিশন লেফটেন্যান্ট-জেনারেল এবং মাইনিং ইঞ্জিনিয়ার উইলহেলম লুডভিগ ভন এসউইজকে দেওয়া হয়েছিল। ভন এসউইজ ছিলেন একজন জার্মান অপেশাদার স্থপতি, নানা দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় তার পরিপূর্ণ ঝুলি আর রাইন নদীর তীরে বেশ কয়েকটি দুর্গ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান ছিল বলেই তিনি এ প্রাসাদকে সূচারুরূপে সাজিয়েছেন। এর সাথে ২০০ হেক্টরজুড়ে পেনা পার্ক আর তার লেক, কৃত্রিম ঝর্ণা আর জলপ্রপাত সব মিলিয়ে স্বর্গোদ্যনকে যেন মর্ত্যে নামিয়ে আনার চেষ্টা।
একটু কল্পনার চোখে তাকালেই হয়ত দেখতে পাবেন উর্বশী আর মেনকারা প্রস্তুত বিশ্বামিত্র্যের ধ্যান ভাঙাতে। আমি তো আর বিশ্বামিত্র নই, ধ্যানেও নেই, তাই উর্বশী মেনকার দেখা পেলাম না। তবে যা পেলাম তাই বা কম কিসে। হাঁটতে হাঁটতে প্যালেসের বিভিন্ন অংশ ঘুরে দেখছিলাম আর অপার বিস্ময়ে বিমোহিত হচ্ছিলাম। আমার সাথের তিন সাথীরও একই অবস্থা। হাঁটতে হাঁটতে প্যালেসের পেছন দিকে চলে এলাম, এখান দিকে যতদূর দৃষ্টি যায় চোখ মেলে দিলাম। অপুর্ব সুন্দর সবুজের মায়ায় চোখ জুড়িয়ে গেল, দূরে দেখা যাচ্ছিল পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে যাওয়া মুরিশ ক্যাসেলের ডাবল ওয়াল, দূর থেকে অনেকটা চীনের প্রাচীরের মতই মনে হচ্ছিল।
আল-ইশবুন শহরকে সুরক্ষিত রাখার কৌশল হিসেবে, দশম শতাব্দীতে সিন্ট্রার মুরিশ দুর্গটি নির্মাণ করা হয়েছিল। এটি পর্তুগালের বা বলা যায় গোটা ইউরোপের মধ্যে, সবচেয়ে ভালোভাবে সংরক্ষিত মুসলিম দুর্গ। কেবলমাত্র বাইরের প্রাচীরটি এখনও টিকে আছে এবং এর পুরনো রয়্যাল টাওয়ার থেকে প্রাসাদের অভ্যন্তর ভাগ পর্যন্ত- পুরো রাস্তাটি হেঁটে যাওয়ার সময় আপনি অবাক হয়ে দেখবেন জাতীয় উদ্যানের পাদদেশের সৌন্দর্য এবং মাঝপথে থাকা অন্যান্য স্থাপত্যশৈলী। আহা কতই না শৌর্য বীর্যের সাক্ষী এই ক্যাসেল, অথচ কোথায় এর বাসিন্দারা। কি নিয়ে এত গর্ব মানুষের। মরার পর তো সেই সাড়ে তিন হাত মাটিই সম্বল। ভাবালুতা কাটিয়ে প্যালেসের সামনের দিকটায় চলে এলাম। টেরেস থেকে সামনে যতদূর দৃষ্টি যায় আবার সবুজের সমারোহ। খানিকটা সময় এখানে কাটিয়ে আবার ঢুকে পড়লাম প্রাসাদের অভ্যন্তরে। এখানে কয়েকটি কক্ষকে জাদুঘরে রূপান্তর করা হয়েছে। ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম জাদুঘরে মূর্ত করে রাখা ইতিহাসকে। সেই আমলের তৈজসপত্র থেকে শুরু করে অস্ত্রপাতি সবই স্থান পেয়েছে ছোট্ট এই জাদুঘরে। হাইরোনোমাইট মঠ, খাবারের ঘর (ডাইনিং রুম), ম্যানুলাইন-রেনেসা চ্যাপেলের অবশিষ্ট অংশ যথাসম্ভব সংরক্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে জাদুঘরে। এর সংরক্ষিত সব মূল্যবান জিনিস একটি নতুন চত্বরসহ একটি এলাকায় সংযুক্ত করা হয়েছে; যার মধ্যে একটি ক্লক টাওয়ার বিদ্যমান। কুইনস টেরেস থেকে পুরো এলাকার সবচেয়ে ভালো ছবি তোলা যায়। এই চত্বরে একটি সূর্য-ঘড়ি ও একটি কামান সংযুক্ত আছে। ক্লক টাওয়ারটির নির্মাণকাজ ১৮৪৩ সালে সমাপ্ত হয়। একটি কক্ষে আবার ডিজিটাল ডিসপ্লের মাধ্যমে প্রদর্শিত হচ্ছে এ প্যালেসের ইতিহাস। হাতে সময় থাকায় মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম এই রোমান্টিক প্যালেসের ইতিহাস।
এ প্রাসাদটির ইতিহাস শুরু হয় মধ্যযুগে, যখন চ্যাপেল আওয়ার লেডি অব পেনাকে উৎসর্গ করে সিন্ট্রা শহরের পাহাড়ের উপর এই প্রাসাদটি নির্মাণ শুরু হয়। ঐতিহ্য অনুযায়ী বলা হয়, কুমারী ম্যারি আবির্ভূত হওয়ার পর এই প্রাসাদের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৪৯৩ সালে, রাজা ২য় জন, তার স্ত্রী রাণি লিওনর এর সাথে তীর্থযাত্রা করার পর, তার প্রতিজ্ঞা পূরণ করেন। তার উত্তরাধিকারী রাজা প্রথম ম্যানুয়েল, এ পবিত্র স্থাপনাটি তার অনেক প্রিয় ছিল। তিনি সন্নাসী জেরমোর কর্তৃক আদেশ পাওয়ার ফলে এই স্থানে একটি আশ্রম তৈরি করার জন্য অর্থ দান করেন। ওই শতকে পেনা অনেক ছোট ছিল, ছিল ধ্যানের জন্য উপযুক্ত স্থান, সেই সময় এখানে মাত্র ১৮ জন সন্ন্যাসী থাকতে পারত।
১৮ শতকে লিসবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভূমিকম্পের সময় আশ্রমটি বজ্রপাতে ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। যদিও “চ্যাপেল” (একটি মার্বেল পাথরের সুন্দর কারুকাজ এবং এর সমাধি) প্রায় অক্ষতই থাকে। এর কিছুদিন পর আশ্রমটি সংস্কার করার জন্য উচ্চহারে ট্যাক্স আরোপ করা হয়। অনেক দশক ধরে ওই ধ্বংসাবশেষের কোনো সংস্কার করা হয়নি। পেনা প্রাসাদ হলো রাজা ডন (ডোম) দ্বিতীয় ফার্নান্দোর কল্পনা, যিনি ১৮৩৮ সালে তৎকালীন উপেক্ষিত এই মঠটি কিনেছিলেন ও তার সংস্কার করে তাকে নবরূপ দিয়েছিলেন। তিনি স্থপতিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যেন উনবিংশ শতকের ইউরোপীয় শৈলীর সাথে বিশ্ব মুসলিম শৈলীর মিশ্রণ ঘটানোর জন্য। এই স্থাপনায় অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে নব্য ইসলামী, নব্য গোথিক, নব্য ম্যানুলাইন এবং নব্য রেনেসাঁ কারুকাজের সমাবেশ। প্রায় পুরো প্রাসাদটি পাথরের ওপর অবস্থিত। গঠনগত দিক থেকে প্রাসাদটিতে চারটি অংশ রয়েছে। রাজা ফারদিনান্দ এবং রাণি ২য় মারিয়া, ওই স্থাপনার সাজসজ্জা ও প্রতীকীকরণে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ফারদিনান্ডের মৃত্যুর পরে প্রাসাদটি তার দ্বিতীয় স্ত্রী এডিশার কাউন্সটেস এলিসা হেনস্লারের হাতে চলে যায়। এরপরে রাজবাড়িটি রাজ পরিবারের জন্য পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা চলে, কিন্তু এলিসা প্যালেসটি রাজা লুসের কাছে বিক্রি করেছিলেন এবং তারপর এই প্রাসাদটি প্রায়শই রাজপরিবার ব্যবহার করত।
১৮৮৯ সালে এ স্থাপনাটি পর্তুগিজ সরকার ক্রয় করে নেন এবং ১৯১০ সালের স্বাধীনতা আন্দোলনের পর এ স্থাপনাকে জাতীয় স্থাপনার স্বীকৃতি দিয়ে জাদুঘরে পরিণত করা হয়। এ প্রাসাদে পর্তুগালের সর্বশেষ রানী অ্যামেলিয়া তার অন্তিম দিনগুলো কাটান, তার স্মৃতিগুলোই আমরা কিছুক্ষণ আগে জাদুঘরের বিভিন্ন কক্ষে দর্শন করে এলাম। সংস্কারের পর প্রাসদটি খুবই দ্রুত পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তা পর্তুগালের সবচেয়ে আইকনিক ট্যুরিস্ট ডেস্টিনেশনে পরিণত হয়। সময়ের সাথে সাথে এর লাল ও হলুদ রঙ ঝাপসা হয়ে যায়। পরবর্তীতে অনেক বছর এটা দেখতে ধূসর রঙের ছিল। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এই প্রাসাদ পুনরায় রঙ করা হয় এবং তার আগের রঙ পুনরুদ্ধার করা হয়।
এ প্রাসাদের গঠনশৈলীতে রোমান্টিসজিমের পূর্ণ বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এই স্থাপনায় অভিপ্রেতভাবে অনেক ধরনের কারুকাজ অনুপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে যেমন- নব্য গোথিক, নব্য ম্যানুলাইন, নব্য ইসলামী এবং নব্য রেনেসাঁ ইত্যাদির কারুকাজের সমাবেশ দেখা যায় এই স্থাপনায়। প্রায় পুরো প্রাসাদটি পাথরের উপরের অবস্থিত।
গঠনগত দিক থেকে প্রাসাদটি চারটি অংশে বিভক্ত— প্রাসাদের ভিত এবং এর দুইটা প্রবেশ তোরণসহ (যার একটি তোরণ একটি একটি ঝুলন্ত সেতু দ্বারা সুরক্ষিত করা হয়েছে) এর চারপাশের দেয়াল; পুনরুদ্ধারকৃত পুরাতন স্থাপনা এবং ক্লক টাওয়ার; মুরিশ টাওয়ারসহ চ্যাপেলের সামনের অংশ ও প্রাসাদের সমান অংশ এবং এর গোলাকৃতি বেষ্টনীসহ ক্যাথেড্রাল ধরনের সজ্জিত ভেতরের অংশ।
আপনার হাতে যদি সময় থাকে তবে সিন্ত্রাতে আরও ঘুরে দেখতে পারেন মন্সেরাত পার্ক এবং প্যালেস আর কুইন্টা দ্য রিগেলেরিয়া প্যালেস। এ প্রাসাদটি তৈরি হয় বিশ শতকের গোড়ার দিকে এবং এর আশেপাশে আপনি একটি প্রাসাদ, জাল, বাগান, একটি রহস্যময় কূপ এবং একটি গ্রিনহাউস উপভোগ করতে পারেন। বর্তমানে এই প্রাসাদটি একটি জাদুঘর এবং এটি বিভিন্ন স্টাইল দ্বারা অনুপ্রাণিত। আপনাকে সুন্দর কূপটি ঘুরে দেখতে হবে, তবে আকর্ষণীয় উদ্যনটিও উপভোগ করতে হবে, যেখানে গোপন টানেল বা জলপ্রপাত রয়েছে। আরেকটা কথা সিন্ত্রার সিগনেচার মিষ্টান্ন পাফ পেস্ট্রি ট্রাভেসেরিওস দ্য সিন্ত্রা বা পিলোস এবং চিজ কেক কুজাদা অব সিন্ত্রা টেস্ট না করে ভুলেও সিন্ত্রা ত্যাগ করবেন না। অন্যথায় আবার প্লেনের টিকিট কাটতে হলে লেখক দায়ী থাকবে না। সিন্ত্রা থেকে এবার আমাদের গন্তব্য সমুদ্রপাড়ের শহর কাসকাইস।
কাসকাইস; সিন্ত্রা থেকে আবারো ফিরতি ট্রেনে চড়লাম। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম পর্তুগালের অন্যতম ট্যুরিস্ট ডেসটিনেশনে। লিসবন থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটারের এই সমুদ্রপাড়ের শহরের লোকসংখ্যা মাত্র ২ লাখ। বর্তমান দুনিয়াতে যত প্রতিযোগিতামূলক আসর বসে তার মধ্যে সবচেয়ে পুরাতন আসর “আমেরিকা কাপ” এখানেই অনুষ্ঠিত হয়। পালতোলা নৌকার রেস হচ্ছে এই আমেরিকা কাপ। আইবেরিয়ান পেনিনসুলার অন্যতম ধনী মিউনিসিপ্যালটি হচ্ছে কাসকাইস। ১৮৭০ সালে পর্তুগালের রাজা প্রথম লুইসের গ্রীষ্মের সি-সাইড রিসোর্ট হিসেবে যাত্রা শুরু হয় কাসকাইসের। এরপর তার হাত ধরে আরো বেশ কিছু ধনাঢ্য পর্তুগিজের আগমন ঘটে কাসকাইসে। বলাবাহুল্য তাদের পদচারণার ফলে কাসকাইস হয়ে উঠে ইউরোপের অন্যতম ধনী শহর। সেই ধারা আজও বিদ্যমান। লিসবনের তুলনায় কাসকাইসের জীবনের মান ও দাম দুটোই অনেক বেশি।
আমরা ট্রেন থেকে নেমে সোজা রওনা দিলাম বিচের দিকে। পথে বেশ কিছু স্যুভেনির শপ আর খাবারের দোকান পড়ল। খাবারের দোকান দেখে মনে পড়লো ঘড়িতে প্রায় ৫টা বাজে, এখনো আমাদের লাঞ্চ করা হয়নি। অগত্যা একটা ইন্ডিয়ান দোকান দেখে কিছু খাবারের অর্ডার দিয়ে বসে পড়লাম। আশপাশে দেশি নানা বয়সী ট্যুরিস্টের ছড়াছড়ি। দোকানের বাংলাদেশি ওয়য়েটারের সাথে কথা বলে জানা গেল, লিসবন থেকে এখানে কাজ করে বেশি ইনকাম হয়, তাই লিসবন ছেড়ে গত ছয় মাস ধরে তিনি এখানে কাজ করছেন। তবে এখানে থাকার যায়গা অনেক উচ্চমূল্য বলে তিনি দূরের এক গ্রাম থেকে প্রতিদিন ট্রেনে করে এসে কাজ শেষ করে আবার ট্রেনেই ফিরে যান নিজের ডেরায়। তার মতো অনেক ওয়ার্কারই এখানে দিনে কাজ করে রাতে ফিরে যান অন্য কোনো ডেরায়। তার কাছ থেকেই জানতে পারলাম এখানে সমুদ্রের পারে বিখ্যাত ফুটবলার ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর একটা ফাইভ স্টার হোটেল আছে। খাবার আসার অপেক্ষার ফাঁকে খালুর কাছ থেকে কাসকাইস সম্পর্কে আরো কিছু তথ্য টুকে নিচ্ছিলাম নোটবুকে।
কাসকাইস একটি উপকূলবর্তী শহর যেটি শুধু লিসবন নয় পর্তুগালের অন্যতম ধনী পৌরসভা। কাসকাইসে মানব বসতির শুরু হয় সেই পুরাতন প্রস্তর যুগের শেষ ভাগে, যদিও বর্তমানের কাসকাইস একদম ঝাঁ-চকচকে নতুন। আর এর পেছনের কারণ ধনী পর্যটকরা বা লিসবনের ধনী সম্প্রদায়ের ছুটি কাটাবার জন্যে এই জায়গায় থাকতেই পছন্দ করে।
এখানে একটা খাড়ি আছে যার নাম বোকা দো ইনফার্নো বা হেলস মাউথ অথবা খাঁটি বাংলায় জাহান্নামের মুখ। এত সুন্দর ক্লিফ নাকি শুধু সিনেমাতে দেখা সম্ভব বা গল্পের বইতেই পাওয়া যায়। এখানে এসে মনে হবে যেন আপনি আপনার স্বপ্নপূরণের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। এবার একবার বুঝুন তো আমার মনের অবস্থা। কিসের লাঞ্চ, মনে হচ্ছে এখনই ছুটে যাই। সিনেমার ইতিহাসের সঙ্গেও কিন্তু এই হেলস মাউথের সম্পর্ক আছে। ১৮৯৬ সালে তৈরি ১৩ সেকেন্ড ব্যাপ্তির একদম প্রথম দিকের নির্বাক সিনেমাগুলোর অন্যতম “অ্যা সি কেইভ নিয়ার লিসবন” এই হেলস মাউথ নিয়েই তৈরি হয়েছিল।
লাঞ্চ সেরে আর দেরি করলাম না। আবারো সেই সাদা-কালো পাথর বিছানো বিচিত্র নকশার রাস্তা ধরে চলে এলাম সমুদ্রের পাড়ে। আকাশের নীল আর সমুদ্রের নীল- কে যে কার চেয়ে বেশি সুন্দর তার যেন প্রতিযোগিতা চলছে। এ বলছে আমাকে দেখ, ও বলছে আমাকে দেখ। প্রতিযোগিতা থাকলেও কোনো মারামারি কাটাকাটি নেই, বরং দুইয়ের যুগলবন্দিতে কাসকাইস হয়ে উঠেছে আরও মোহনীয়।
তবে এখন আকাশ বা সমুদ্র কোনটাতেই নয় বরং চোখ আটকে গেল বিচের ওপর সংক্ষিপ্ত পোশাকে সমুদ্রস্নানরত ললনাদের অর্ধনগ্ন দেহের দিকে। এটা এমন এক অমোঘ আকর্ষণ, যার কাছে আকাশ আর সমুদ্র তো তুচ্ছ। কত মুনি-হৃষির ধ্যান ছুটে গিয়েছে আর আমি তো কোন ছাড়। দুই মামা আমার সমবয়সী হলেও খালু তো মুরুব্বি, তাই খুব বেশিক্ষণ আর সেই দিকে দৃষ্টি দেওয়া গেল না। কী আর করা মনে কষ্ট নিয়েই বিচকে পেছনে রেখে সামনে একটা ক্লিফের দিকে এগিয়ে চললাম। একে তো ধনীদের পছন্দের গন্তব্য তার ওপর উপকূলবর্তী শহর- ফলে একটি ইয়ট হারাবার তো না থেকেই পারে না। রাজা কার্লোস-১ এর মূর্তির সামনে দিয়ে একটু হেঁটেই পৌঁছে গেলাম ইয়ট হারবারে। সেখানে গিয়ে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটালাম, মানে ইয়টে চড়ার সুযোগ না পেলেও বাইরে থেকেই দেখলাম নানা ধরনের নানা আঁকারের ইয়ট। ইয়ট হারবার থেকে বের হয়ে ডানদিকে মনোমুগ্ধকর সব ভিলা আর বাঁ-দিকে উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর রেখে আমরা হেঁটে চললাম সামনের দিকে।
এক জায়গায় বেশ কিছু সি-গালের উড়াউড়ি। সমুদ্রের পারে বসে অপলকে উপভোগ করছিলাম এ সৌন্দর্য। কিছু জায়গায় লোকাল লোকজন ব্যস্ত হয়ে আছে হুইল ছিপ দিয়ে মাছ ধরতে। এর মধ্যে একজন সমুদ্রের পাড়ে একটা পাথরের খাজে বসে তন্ময় হয়ে বই পড়ছে, আর সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে তাকে হালকা ঝাপটায় ভিজিয়ে দিচ্ছে। একটু চিন্তা করে দেখুন তো পরিস্থিতিটা। আমার তো ইচ্ছা করছে পুরো বিকালটাই যদি এখানে বসে কাটাতে পারতাম। আরও ভালো হতো যদি জীবনসঙ্গিনী পাশে থাকতো। মনে পড়ে গেল সেই গানটার কথা- “সন্ধ্যাবেলায় তুমি আমি বসে আছি দুজনে, তুমি বলবে আমি শুনব”। কিন্তু বাস্তব বড় নিষ্ঠুর, একে তো সঙ্গিনী সাথে নেই, তার ওপর আমাদের ফিরতে হবে লিসবন শহরে। তাই ভগ্ন মনোরথেই ফিরতি পথে রওনা দিলাম। লেখক: আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (শাকিল), চিকিৎসক, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল