রাস্তা নেই ১৭ কোটি টাকার চার সেতুতে

দেশজুড়ে breaking subled

নিউজ ডেষ্ক- সেতু নির্মিত হলেও সংযোগ সড়ক নেই। তাই সেতুর ওপর দিয়ে চলাচল করা যায় না। নেত্রকোনা-ঈশ্বরগঞ্জ সড়কে নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিশিউড়া এলাকায় মগড়া নদীর ওপরে সেতু। ছবি : কালের কণ্ঠ

সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গতিশীল করতে নেত্রকোনায় ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১১টি সেতু নির্মিত হয়েছে। এর মধ্যে সংযোগ সড়ক না হওয়ায় চারটি সেতু কোনো কাজে আসছে না। তিন জায়গায় নতুন সেতুর পরিবর্তে আগের জরাজীর্ণ সেতু দিয়ে চলছে যানবাহন।

সেতুসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণ করতে না পারায় সংযোগ সড়ক বানানো যাচ্ছে না।

এতে প্রায় ১৭ কোটি টাকায় নির্মিত চার সেতুর সুফল পাচ্ছে না মানুষ। আর জমির মালিকরা বলছেন, জমি অধিগ্রহণের চিঠি হাতে পেলেও তাঁরা টাকা পাননি। এ জন্য তাঁরা জমি ছাড়ছেন না।

কলমাকান্দা সড়কে ৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১১টি নতুন সেতু নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে সড়কের ভাউসী, হীরাকান্দা ও মুন্সীখালী এলাকায় নির্মিত তিনটি সেতু সড়কের সঙ্গে সংযোগ দেওয়া যাচ্ছে না। ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় আটকে রয়েছে এই তিন সেতুর দুই পাশের সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ। একই কারণে নেত্রকোনা-ঈশ্বরগঞ্জ সড়কের নেত্রকোনা সদর উপজেলার বিশিউড়া এলাকায় মগড়া নদীর ওপর নির্মিত সেতুর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা যাচ্ছে না। সড়ক বিভাগ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে প্রায় সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে এই সেতুটি নির্মাণ করে। সেতুর প্রয়োজনে উভয় পাশে ব্যক্তিমালিকানাধীন জমির প্রয়োজন হয়। কিন্তু জমির মালিকরা ক্ষতিপূরণ বুঝে না পেয়ে জায়গা দিতে রাজি নন।

২২ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নেত্রকোনা-কলমাকান্দা সড়কের ভাউসী এলাকায় কংশ নদের ওপর নির্মিত সেতুর দুই পাশে দোকানপাট, ফসলি জমি। পশ্চিম পাশে জাহাঙ্গীরপুর এলাকায় সেতুর মুখের সামনের জমির মালিক ফেরদৌস মিয়া ডাঁটা চাষ করেছেন। পাশেই তাঁর মুদি দোকান। তিনি বলেন, ‘আমার এখানে ১৫ শতক জমি। এটুকুই সম্বল। এনজিও থেকে এক লাখ টাকা ঋণ নিয়ে এই মুদি দোকান দিয়েছি। এর আয়েই চলে সংসার, দুই ছেলের লেখাপড়া। এখন কিছু লোক এসে আমাকে টাকা না দিয়েই দোকান ভেঙে জমি ছেড়ে দেওয়ার জন্য হুমকি দেয়। ’ ভাউসী এলাকার কয়েকজন দোকানদার জানান, তাঁরা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে জমি অধিগ্রহণের চিঠি পেয়েছেন। তবে দীর্ঘদিনেও তাঁরা টাকা পাননি।

নেত্রকোনা সদরের ভাউসী এলাকায় নবনির্মিত সেতুর পাশেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ বেইলি সেতু’ সকর্তবাণী লেখা সড়ক বিভাগের একটি সাইনবোর্ড টানানো। জোড়াতালির বেইলি সেতুর ওপর দিয়েই ঝুঁকি নিয়ে যান চলাচল করছে। একই সড়কের মুন্সীখালী এলাকায় বেইলি ব্রিজের সামনের একটি বাড়ির মালিক কৃষক মো. আবুল কালাম। তিনি বলেন, ‘এই ব্রিজের এক পাশে আমার ১০ শতাংশ জমি দখল করে ব্রিজ করা হয়েছে। কোনো টাকা পাইনি। এখন এই পাশে আমার বাড়ি উচ্ছেদের জন্য পাঁয়তারা চলছে। ’

সড়কের কলমাকান্দার হীরাকান্দা এলাকায় পড়ে আছে আরেকটি সংযোগবিহীন সেতু। সেতুর কাছেই হীরাকান্দা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানেও ভাঙা বেইলি সেতু দিয়ে চলছে যানবাহন। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হামিদুল হক বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না করেই বিদ্যালয়ের জায়গায় মাটি ভরাট শুরু করেন ঠিকাদার। এতে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির লোকজন বাধা দিলে মাটি ভরাট বন্ধ থাকে। ’ কাছেই আরেক বাড়ির বাসিন্দা ফাতেমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী মরছে ১৬ বছর অইছে। সড়কের লগেই স্বামীর কবর দিছলাম। অহন ব্রিজের লাইগ্যায়া কবরের জায়গা নিয়া যাইব। জমির টেহা ত হাইলাম না। ’

কলমাকান্দার বাসচালক মো. রুকন মিয়া বলেন, ‘সড়কের সঙ্গে ব্রিজগুলোর সংযোগ না হওয়ায় ঝুঁকি নিয়ে পুরাতন বেইলি ব্রিজ দিয়ে বাস চালাতে হয়। সম্প্রতি ভাউসীর বেইলি সেতুটি ভেঙে পড়ায় ১৫ কিলোমিটার ঘুরে বারহাট্টা দিয়ে কলমাকান্দায় যেতে হয়েছে। ওই সড়কে মোট ২২টি বাস চলাচল করে। বৃষ্টি হলে বেইলি সেতুতে গাড়ি নিয়ে উঠতে অসুবিধা হয়। গাড়ির পাত্তি ভেঙে যায়। যাত্রীদের কষ্ট হয়। ’

ঈশ্বরগঞ্জ সড়কের বিশিউড়া এলাকায় মগড়া নদীর ওপর নতুন সেতুটির পশ্চিম পাশে পুরাতন সরু সেতু দিয়ে যানবাহনসহ মানুষ চলাচল করছে। ঈশ্বরগঞ্জ সড়কের বিশিউড়া এলাকার জমির মালিক শিক্ষক শেখ আব্দুল কাদির বলেন, ‘আমার বাড়ির সামনে মগড়া নদীর ওপর ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়েছে। জমির টাকা না পাওয়ায় বাড়ি সরিয়ে নিতে পারছি না। বাড়ি ছেড়ে দিতে হবে, এ জন্য বাড়িতে কোনো ঘরও তৈরি করা যাচ্ছে না। দীর্ঘদিন ধরে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। ’

নেত্রকোনা-কলমাকান্দা সড়কের তিনটি সেতু নির্মাণ করেছে এম এইচ কনস্ট্রাকশন নামে ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইউসুফ আলী বলেন, ‘আমরা সংযোগ সড়কের কাজ করতে গেলে স্থানীয় লোকজন বাধা দেয়। তারা জমির টাকা না পেয়ে জায়গা দিবে না। আমাদের লোকবল যন্ত্রপাতি নিয়ে কাজ শুরু করে বারবার ফিরে আসছে। এতে আমাদের ক্ষতি হচ্ছে। ’ ঈশ্বরগঞ্জ সড়কের সেতুটি নির্মাণ করেছে রিজভী কনস্ট্রাশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।

নেত্রকোনা সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার শরীফ খান বলেন, জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় সেতুগুলোর সংযোগ সড়ক নির্মাণ করা যাচ্ছে না। জমি অধিগ্রহণ করবে জেলা প্রশাসন। জমির সমস্যা সমাধান হলেই ঠিকাদারের মাধ্যমে দ্রুত কাজ শেষ করা হবে। তিনি জানান, এই চার সেতুর প্রতিটির নির্মাণে ব্যয় হয়েছে কমবেশি চার কোটি টাকা।

নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের ভূমি অধিগ্রহণ কর্মকর্তা সাদিয়া ইসলাম সীমা কালের কণ্ঠকে বলেন, কলমাকান্দা সড়কে জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রাক্কলন তৈরির কাজ চলছে। এক সপ্তাহের মধ্যেই এগুলো ঢাকায় সড়ক বিভাগে পাঠানো হবে। আর ঈশ্বরগঞ্জ সড়কে জমির মালিকদের টাকা দেওয়ার জন্য অ্যাওয়ার্ড বুক তৈরি (টাকা দেওয়ার বই) ও নোটিশ জারির কাজ চলছে। খুব দ্রুতই জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন করা হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *