বৈধ বিনিয়োগের চেয়ে ১৮০০ গুণ বেশি অর্থপাচার হচ্ছে বিদেশে

অর্থনীতি

নিউজ ডেষ্ক- বিদেশে বৈধভাবে বিনিয়োগে আগ্রহ কম দেশীয় ব্যবসায়ীদের। গত ৯ বছরে মাত্র ১৮টি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমোদন নিয়েছে। অনুমোদিত বিনিয়োগের পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকার। এর মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৭টি প্রতিষ্ঠান ৩৪৫ কোটি টাকার মতো বিনিয়োগ করেছে। ফলে প্রতি বছর গড়ে বিদেশে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৩৮ কোটি টাকা। তবে বৈধ অনুমোদন ছাড়াও অনেকেই বিদেশে টাকা নিয়ে বিনিয়োগ করছেন, সম্পদ গড়ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির’ (জিএফআই) ২০২১ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে ৭০ হাজার কোটি টাকা পাচার হচ্ছে। এর মানে বছরে বৈধ বিনিয়োগের চেয়ে ১৮০০ গুণ বেশি অর্থপাচার হচ্ছে। বিভিন্ন পন্থায় দেশ থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার হলেও পাচারকারীরা থাকছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এত দিন শর্তসাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ ছিল। তারপরও বৈধ বিনিয়োগ তেমন হয়নি। এর পরিবর্তে প্রতি বছর বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হচ্ছে। এখন বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ

উন্মুক্ত করা হয়েছে। এই সুযোগ দেওয়ার পরও অর্থপাচার কমবে বলে মনে হয় না। যারা পাচার করবে, তারা করবেই। এ ছাড়া বৈধ বিনিয়োগের আড়ালেও অর্থপাচার বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দিয়ে বসে থাকলে হবে না। বিনিয়োগ থেকে দেশে রিটার্ন আসছে কি না, সেটিও দেখতে হবে।’

অর্থপাচার রোধ করা যাচ্ছে না কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত অর্থপাচার থামবে না।’

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশ থেকে প্রতি বছর যে পরিমাণ অর্থপাচার হয়, তার প্রায় ৮০ শতাংশই হচ্ছে বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে। বর্তমানে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে।

বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) উদ্যোগ বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও ভ্যাসেল ট্রেকিং বিষয়ে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগের অগ্রগতি বাস্তবায়নে গঠিত কমিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় আন্তর্জাতিক বিশ্বে আমদানি ও রপ্তানি বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে। যার ফলে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের প্রবণতাও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থ আমদানি ও রপ্তানি প্রক্রিয়ায় পণ্য বা সেবার মূল্য প্রভৃতি পরিশোধের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়। সাধারণত আমদানিতে মূল্য বেশি দেখানো (ওভার ইনভয়েসিং), রপ্তানিতে মূল্য কম দেখানো (আন্ডার ইনভয়েসিং), মাল্টিপল ইনভয়েসিং, শর্ট ও ওভার শিপমেন্ট, ফ্যান্টম শিপমেন্ট এবং ডিসকাউন্ট অথবা পণ্যমূল্য পরিবর্তনের মাধ্যমে অর্থপাচার হয়ে থাকে। এর বাইরে হুন্ডি পথেও বিদেশে অর্থপাচার হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য, ২০১৩ সালে মবিল যমুনা বা এমজেএল বাংলাদেশ নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পায়। এরপর থেকে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৮টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিদেশে বিনিয়োগের অনুমতি পেয়েছে।

জিএফআইয়ের প্রতিবেদন বলছে, ২০০৯ সালের পরে মূল্য ঘোষণায় গরমিল দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচারের পরিমাণ বেড়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে সর্বোচ্চ ১১৮৭ কোটি ডলার পাচার হয়েছে। ২০০৯ সালে ছিল ৫২১ কোটি ডলার। এ ছাড়া ২০১০ সালে ৬৮৪ কোটি, ২০১১ সালে ৮৭৩ কোটি, ২০১২ সালে ৭৬৪ কোটি ও ২০১৩ সালে ৯৩৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার পাচার হয়। সব মিলিয়ে ২০০৯ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত (২০১৪ বাদে) ছয় বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। প্রতি বছর গড়ে পাচার হয়েছে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা।

অন্যদিকে গত জুনে সুইজারল্যান্ডের সুইস ন্যাশনাল ব্যাংকের (এসএনবি) ‘ব্যাংকস ইন সুইজারল্যান্ড-২০২০’ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সুইজারল্যান্ডের ব্যাংকগুলোতে বাংলাদেশিদের জমা থাকা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ২০৩ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক ড. তৌফিক আহমেদ চৌধুরী বলেন, পাচারকারীদের অধিকাংশই কালোটাকার মালিক। কালোটাকা তারা বিভিন্ন পন্থায় পাচার করেন। কিন্তু বৈধভাবে বিদেশে পুঁজি বিনিয়োগ সেভাবে হয়নি।

তিনি বলেন, ‘যারা খারাপ মানুষ, যাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই, তাদের জন্য যতই প্রতিবন্ধকতা বা সুবিধা কার্যকর করা হোক, তারা পাচার করবেই। এখন বিদেশে বিনিয়োগ উন্মুক্ত হওয়ায় বৈধ মোড়কেও পুঁজি পাচার হবে।’

এত দিন বাংলাদেশ থেকে বিদেশে বিনিয়োগ উন্মুক্ত ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে শর্তসাপেক্ষে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ পেতেন দেশীয় উদ্যোক্তারা। তবে সম্প্রতি বিদেশে বিনিয়োগের পথ উন্মুক্ত করে বিধিমালা জারি করেছে সরকার। তবে বিদেশে বিনিয়োগের এ সুযোগ পাবেন শুধু রপ্তানিকারকরা। বিনিয়োগে আগ্রহী যে কোনো প্রতিষ্ঠান তাদের আগের পাঁচ বছরের গড় রপ্তানি আয়ের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ অথবা তার সর্বশেষ নিরীক্ষিত বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদনে প্রদর্শিত নিট সম্পদের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বিনিয়োগ করতে পারবে। তবে এক্ষেত্রেও আগের মতোই বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে।

অর্থপাচার রোধে বিদেশে বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে বলে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। গত ৩০ জানুয়ারি সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত সভা শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে অর্থমন্ত্রী বলেন, বিদেশে বিনিয়োগ করা অন্যায় কিছু নয়। যদি অনুমোদন না করেন, এটা হুন্ডির মাধ্যমে চলে যাবে বিভিন্ন দেশে। তার চেয়ে অফিসিয়ালি অ্যালাও করা ভালো।

এদিকে কর ফাঁকি ও অর্থপাচারে জড়িত অভিযোগে ৬৯ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের তালিকা গত জানুয়ারিতে আদালতে দাখিল করে বিএফআইইউ। বিভিন্ন সময়ে পানামা ও প্যারাডাইস পেপারসে এসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে আসে। তবে কত টাকা পাচার হয়েছে, সুনির্দিষ্টভাবে সেই তথ্য হাইকোর্টে দিতে পারেনি বিএফআইইউ। কানাডায় অর্থপাচারকারী কারো নামও দিতে পারেনি বিএফআইইউ। এর বাইরে বিভিন্ন দেশের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (এফআইইউ) এবং এফআইইউগুলোর সমন্বয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক ফোরাম ‘এগমন্ট’ থেকে ১০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে তথ্য পাওয়া গেছে বলে আদালতকে জানিয়েছে বিএফআইইউ। প্রাপ্ততথ্যের ভিত্তিতে এই ১০ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে পাঠানো হয়েছে বলেও জানায় সংস্থাটি।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *