বিপাকে নির্মাণকারীরা: লাগামহীন রডের দাম, বাড়ছে ফ্ল্যাটের দামও

বাণিজ্য

বেড়েই চলেছে নির্মাণসামগ্রী রডের দাম। বাড়তে বাড়তে কোম্পানির মানভেদে (৬০ গ্রেডের ওপরে) খুচরায় রডের টন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৩ হাজার টাকা পর্যন্ত।

দাম এমন অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বাড়ি নির্মাণকারী, আবাসন ব্যবসায়ী ও সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ইতোমধ্যেই ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আবাসন ব্যবসায়ীরা।

চট্টগ্রামের সরকারি প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানে দাবি, নির্মাণসামগ্রীর দামের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো না হলে তারা কাজ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হবেন। এমনকি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

তবে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি, রডের কাঁচামাল স্ক্র্যাপ লোহা দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব, জাহাজ ভাড়া বৃদ্ধিসহ নানা কারণে দেশের বাজারে বেড়েছে রডের দাম। তুলনামূলক কম দামেই তারা রড বিক্রি করছেন। সময় অনুযায়ী আরও বেশি দামে বিক্রি করা দরকার বলে দাবি তাদের।

এদিকে, তিন দিনের মধ্যেই দুই দফা দাম বেড়েছে। ক্রেতারা বলছেন, তিন দিনের মধ্যে দুই দফা রডের দাম বাড়ানোর কোনও যুক্তি হতে পারে না। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে রডের দাম বাড়িয়েছে। নগরীর ২ নম্বর ষোলশহর এলাকার খুচরায় রড বিক্রেতা ‘আলমাস ট্রেডিং’র মালিক ইমাম হোসেন বলেন, ‘সোম থেকে বুধবারের মধ্যে দুই দফা রডের দাম বেড়েছে। দাম বেড়ে পাইকারিতে বিএসআরএমের রড ৮৯, কেএসআরএমের ৮৭ হাজার ৫০০, জিপিএইচ ৮৭ হাজার ৫০০, বায়েজিদ স্টিল ৮৭ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে খুচরায় ৯০ থেকে ৯৩ হাজার টাকায় বিক্রি করা হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘রডের দাম বেড়ে যাওয়া খুচরা পর্যায়ে বিক্রি অনেক কমে গেছে। ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণকারীর ও সরকারি ঠিকাদাররা দাম কমার অপেক্ষায় রয়েছেন।’ কেন দফায় দফায় দাম বাড়ছে তা চিহ্নিত করে সমাধানের দাবি জানান তিনি। রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী চৌমুহনী বাজার রড-সিমেন্ট বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ‘আল মদিনা ট্রেডার্স’র মালিক জি এম মোস্তফা বলেন, ‘বর্তমানে আমরা খুচরায় বিএসআরএম ৯৩ হাজার, কেএসআরএম ৯১ হাজার, বায়েজিদ স্টিল ৯০ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। মাত্র তিন দিনের ব্যবধানে রডের দাম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা বাড়িয়েছে কোম্পানিগুলো। দাম বাড়ায় বিক্রিও কমেছে।’

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, ‘তিন দিনের মধ্যে দুই দফায় রডের দাম বাড়ানোর কোনও যুক্তি নেই। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, স্ক্র্যাপের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছে। সরকারকে নজর দিতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়বে ফ্ল্যাটের দামে। আমরা ইতোমধ্যে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কেননা যে হারে রডসহ নির্মাণসামগ্রীর ব্যয় বেড়েছে এর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ফ্ল্যাটের দাম বাড়ানো না হলে আমাদের ঠিকে থাকা দায় হয়ে পড়বে।’

এদিকে, রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম বৃদ্ধির প্রতিবাদে ১৩ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম এলজিইডি ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতি। পরে তাদের কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ও শিক্ষা প্রকৌশল অধিদফতরসহ একাধিক ঠিকাদার সমিতির কর্মকর্তারা। চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান টিটু বলেন, ‘মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে রডের দাম ১৫ হাজার টাকা করে বেড়েছে। এটা মানা যায় না। আমরা যেসব কাজ পেয়েছি সেগুলো বর্তমানে চালু রাখা সম্ভব হবে না। রডসহ নির্মাণসামগ্রীর দাম কমানোর জন্য আমরা আন্দোলনে যাবো। বুধবার আমরা বিভিন্ন সেক্টরের ঠিকাদারদের সমন্বয়ে একটি আহ্বায়ক কমিটি করেছি। দুই-এক দিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি ঘোষণার প্রস্তুতি চলছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা যেসব প্রকল্পের কাজ পেয়েছি, সব কাজের বিপরীতে ১০ শতাংশ টাকা সরকারের ফান্ডে জমা রাখতে হয়েছে। যদি কাজ না করি তাহলে ওই টাকা আমরা পাবো না। যদি কাজ করি তাহলে ২০ শতাংশ করে লোকসান গুনতে হবে। আমরা বুঝে উঠতে পারছি না এখন কী করব।’ উৎপাদনকারীদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের নভেম্বর মাসে দেশের বাজারে রডের টন সর্বোচ্চ ৮১ হাজার টাকায় উঠেছিল, যা তখন দেশের ইতিহাসের রেকর্ড দাম ছিল। তার আগে ওয়ান-ইলেভেনের (২০০৭-০৮) সরকারের সময় প্রতি টন রডের দাম সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। চলতি বছরের শুরুতে রডের দাম কিছুটা কমে টনপ্রতি ৭৬ হাজার টাকায় নেমে আসে। তবে জানুয়ারির শেষ দিকে এসে আবারও বাড়তে থাকে। গত ১৫ বছরের মধ্যে বর্তমানে সর্বোচ্চ ৯৩ হাজার টাকায় উঠলো রডের টন।

বায়েজিদ স্টিলের সিনিয়র বিক্রয়কর্মী আমজাদ হোসেন বলেন, ‘বুধবার বায়েজিদ স্টিলের রড টন প্রতি ৮৭ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়। বৃহস্পতি ও শুক্রবার অফিস বন্ধ।’ শনিবার দাম আরেক দফা বাড়তে পারে বলেও মত দেন তিনি। বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসাদুল আলম মাসুদ বলেন, ‘বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের দাম ৬৭০ থেকে ৭২০ ডলারে বিক্রি হচ্ছে। দেশের লোকাল মার্কেট থেকে স্ক্র্যাপ কিনতে হচ্ছে ৫৮ থেকে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। শিপ ইয়ার্ডের স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ হাজার ৫০০ টাকায়। এসব স্ক্র্যাপ ঢাকায় আনতে টন প্রতি আরও দুই হাজার টাকা করে খরচ পড়ে। বেশি দামে কাঁচামাল কেনার কারণে বেশি দামে রড বিক্রি করতে হচ্ছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘স্ক্র্যাপ এর দাম বেড়েছে তা নয়, রড তৈরিতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয় তার সবগুলোই বেড়েছে। এর মধ্যে একটি কেমিক্যাল আগে কিনতাম ৭০০ ডলারে। বর্তমানে কিনতে হচ্ছে এক হাজার ৭৫০ ডলারে।’ বাংলাদেশ শিপ ব্রেকার্স অ্যান্ড রিসাইক্লার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিআর) সহকারী সচিব নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘বর্তমানে শিপ ইয়ার্ড আছে ৪৫টি। অধিকাংশতেই নেই জাহাজ। তার ওপর স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি গত দেড় মাসে অনেক কমে গেছে। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে জাহাজ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে ১০টি এবং চলতি মার্চ মাসে এ পর্যন্ত মাত্র পাঁচটির মতো জাহাজ আমদানির জন্য এলসি খোলা হয়েছে।’

পুরনো জাহাজ আমদানি কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘স্ক্র্যাপ জাহাজের উচ্চ মূল্য এবং স্ক্র্যাপের অস্থিতিশীল বাজার। এ কারণে আমদানিকারকরা দোটানায় আছেন। কখন আবার দাম কমে কিংবা বাড়ে। এ কারণে আমদানি অনেক কমে গেছে।’ বিএসবিআরের সহ-সভাপতি কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে পুরনো জাহাজের দাম অনেক বাড়তি। জাহাজের দাম বাড়লেও বুধবার স্ক্র্যাপের দাম টন প্রতি চার হাজার টাকা পর্যন্ত কমেছে। এক সপ্তাহ আগেও যেখানে স্ক্র্যাপ বিক্রি হয়েছে টন প্রতি ৭০ হাজার ৫০০ টাকা। সেখানে বুধবার বিক্রি করা হয়েছে ৬৬ হাজার ৫০০ টাকায়।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমানে তিন থেকে সাড়ে ৩ লাট টন স্ক্র্যাপ শিপ-ইয়ার্ডগুলোতে মজুত আছে। রডের দাম বেড়ে যাওয়ায় বিক্রি কমে গেছে হয়তো এ কারণে স্ক্র্যাপের দাম কমেছে। ’

বিএসআরএম’র উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন সেন গুপ্ত বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তানে রডের দাম বাংলাদেশি টাকায় এক লাখেরও বেশি। অথচ ভারতে নিজেদেরই কাঁচামাল রয়েছে। সেক্ষেত্রে ধরতে গেলে বাংলাদেশ তো রডের পুরো কাঁচামাল আমদানি নির্ভর। আমরা এখন যে দামে রড বিক্রি করছি, সব ব্যয় ধরতে গেলে আরও ১০ হাজার টাকা বাড়তিতে বিক্রি প্রয়োজন। কিন্তু সরকারি সব প্রকল্পের কাজ যাতে চলমান থাকে, তা বিবেচনা করে বর্তমান বাজার মূল্য নির্ধারণ করেছি।’ বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, দেশে স্বয়ংক্রিয় ইস্পাত কারখানা আছে ৩০টি। সনাতন পদ্ধতির কারখানা আছে ১০০টির মতো। বছরে দেশে রডের চাহিদা আছে ৫০ থেকে ৫৫ লাখ টন। এই হিসাবে মাসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ টন রড দরকার হয়। রড তৈরির কাঁচামাল হলো পুরনো লোহার টুকরো। এই কাঁচামাল সরাসরি আমদানি করে প্রায় ৬০-৭০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করেন উৎপাদকরা। বাকি প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ আসে জাহাজভাঙা শিল্প এবং লোকাল ভাঙারি বর্জ্য থেকে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *