নিউজ ডেষ্ক- দেশের ধারাবাহিক উন্নয়নের তালিকায় থাকা পদ্মা সেতু নিয়ে সবচেয়ে বেশি কৌতূহল ছিল মানুষের। সব কৌতূহলের অবসান ঘটিয়ে গত ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হয়েছে। এরপর কৌতূহল ছিল কর্ণফুলী টানেল নিয়ে। ৭ জানুয়ারি সন্ধ্যায় সরকারের তৃতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, অক্টোবরে এ টানেলের উদ্বোধন করা হবে।
অর্থাৎ আর কয়েক দিন পর। এখন ঢাকা শহরের মানুষ অপেক্ষায় আছে মেট্রোরেলে চড়ে অফিস বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়ার। মেট্রোরেলে চড়ে একটু ঘুরে বেড়াবার।
সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ডিসেম্বরেই মেট্রোরেলের উদ্বোধন করা হবে। আশা করা যায়, বিজয়ের মাসে মেট্রোরেলে লাল-সবুজ পোশাক পরে আনন্দ করা যাবে। এবার অতীতের চেয়ে খানিকটা ভিন্নভাবে বিজয় উদযাপন করা যাবে। মেট্রোরেলে ওড়ানো যাবে লাল-সবুজের পতাকা।
বাংলাদেশে রেলের যাত্রা কবে শুরু হয়েছে, কেন সরকার মেট্রারেলের পরিকল্পনা গ্রহণ করল এবং রেল নিয়ে কোনো প্রকল্প বর্তমানে চালু আছে। আজকের লেখায় উল্লিখিত বিষয়ের আদ্যোপান্ত তুলে ধরা হয়েছে। খবর আরটিভি
একনজরে মেট্রোরেল
২০২১ সালের ১০ মে উত্তরায় মেট্রোরেলের ডিপোতে বিদ্যুতের সাহায্যে দেশের ইতিহাসে মেট্রোরেল ইঞ্জিনের প্রথম চলাচল দেখানো হয়। এদিন জাপানের কাওয়াসাকি কোম্পানির একজন চালক ট্রেনটির ইঞ্জিন চালিয়ে ছয়টি বগির সেট নিয়ে ওয়ার্কশপ থেকে ৫০০ মিটার পাড়ি দেন। আধাঘণ্টা চলার পর ট্রেনটিকে উত্তরা ওয়ার্কশপে রাখা হয়।
২০২১ সালের ২৮ আগস্ট পরীক্ষামূলকভাবে মেট্রোরেল চালিয়ে দেখা হয়। সেদিন ট্রেনটি ১৬টি স্টেশনের মধ্যে কার্যক্রম শেষ হওয়া চারটি স্টেশনের মধ্যে চলাচল করে। সরকারের সবশেষ ঘোষণা অনুযায়ী, ডিসেম্বর ২০২২ নাগাদ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
ইতোমধ্যে মেট্রোরেলের ভাড়াও নির্ধারণ করা হয়েছে। সর্বনিম্ন ভাড়া ২০ টাকা, যা দিয়ে সর্বোচ্চ দুই স্টেশন পর্যন্ত যাওয়া যাবে এবং সর্বোচ্চ ভাড়া ৯০ টাকা (উত্তরা টু মতিঝিল পর্যন্ত)।
১১০ কিলোমিটার গতিতে চলার সক্ষমতা রয়েছে মেট্রোরেলের। তবে পরীক্ষামূলক চলাচলের সময় পাঁচ কিলোমিটার গতিতে চলে মেট্রোরেল। ধীরে ধীরে গতি বাড়িয়ে ২৫ কিলোমিটার গতিতে চলবে। প্রথম দিকে চালাবেন জাপানি চালকরা। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশি চালকদের হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়া হবে। বর্তমানে বাংলাদেশি চালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
ঢাকা শহরের যানজট কমিয়ে আনার জন্য ২০১৩ সালে মেট্রোরেল স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। ২০১৬ সালে মেট্রোরেলের লাইনের সংখ্যা ৩টি থেকে বাড়িয়ে ৫টি করা হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জুন ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-৬ এর নির্মাণকাজ শুরু করে।
মেট্রোরেল প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয় ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এ প্রকল্পে সহায়তা হিসেবে জাইকার রয়েছে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা।
মেট্রোরেলের পূর্ণ যাত্রা শুরু হলে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত দু’দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী এবং শুরুতে প্রতিদিন ৪ লাখ ৮৩ হাজার যাত্রী যাতায়াত করতে পারবেন। ধারণা করা হচ্ছে উত্তরা থেকে মতিঝিল যাতায়াতে সময় লাগবে মাত্র ৩৫ মিনিট।
প্রচলিত ইঞ্জিনে চলবে না মেট্রোরেল! বরং কোচের নিচে চাকার কাছে থাকবে মোটর লাগানো। বিদ্যুতে মোটর ঘুরবে এবং রেল তার আপন গতিতে চলবে।
রেলের বিবর্তন : ভারতবর্ষ থেকে বাংলাদেশ
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলাদেশে (তৎকালীন ভারতবর্ষ) প্রথম রেলওয়ের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে নামের কোম্পানি প্রথম বাংলাদেশে (তৎকালীন ভারতবর্ষ) রেলপথ স্থাপন করে। ১৮৬২ সালের ১৫ নভেম্বর চুয়াডাঙ্গার দর্শনা থেকে কুষ্টিয়ার জগতি পর্যন্ত রেলপথ স্থাপনের মাধ্যমে বাংলাদেশ রেলযুগে প্রবেশ করে।
এরপর গোয়ালন্দ পর্যন্ত সেকশনটি চালু হয় ১৮৭১ সালের ১ জানুয়ারি। ১৮৭৪–১৮৭৯ সালে পার্বতীপুর থেকে দিনাজপুর এবং পার্বতীপুর থেকে কাউনিয়া পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটিও চালু করে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে। ১৮৮৪ সালের ১ জুলাই ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলে আসে এবং ১৮৮৭ সালের ১ এপ্রিল তা নর্দান বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ের সঙ্গে একীভূত হয়।
১৮৮২–১৮৮৪ সালে ঢাকা স্টেট রেলওয়ে নামক একটি ছোট কোম্পানি দমদম জংশন থেকে খুলনা পর্যন্ত প্রায় ২০৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্রড-গেজ সেকশন চালু করে।
১৮৯৯–১৯০০ সালে ব্রহ্মপুত্র-সুলতানপুর রেলওয়ে ব্রাঞ্চ নামের একটি কোম্পানি সান্তাহার জংশন থেকে ফুলছড়ি পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটি চালু করে।
১৯১৪ সালে শাকোলে থেকে সান্তাহার পর্যন্ত মিটার-গেজ সেকশনটিকে ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হয় এবং ১৯২৪ সালে সান্তাহার থেকে পার্বতীপুর পর্যন্ত প্রায় ৯৬ কিলোমিটার সেকশনটিকে মিটার-গেজ থেকে ব্রড-গেজে রূপান্তরিত করা হয়।
১৮৯৮–১৮৯৯ সালে ময়মনসিংহ হতে জগন্নাথগঞ্জ পর্যন্ত প্রায় ৮৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ব্যক্তি মালিকানাধীন মিটার-গেজ রেলপথ সেকশনটি চালু হয়, যা পরে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্তির পর পূর্ব বাংলা তথা পূর্ব পাকিস্তান উত্তরাধিকার সূত্রে পায় ২,৬০৬.৫৯ কি.মি রেললাইন এবং তা ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ে (ইবিআর) নামে পরিচিত হয়। ইবিআর পায় ৫০০ কিলোমিটার ব্রডগেজ এবং ২,১০০ কিলোমিটার মিটারগেজ। কিন্তু সে সময় রেলখাতে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়ের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে রাখা হয়। উত্তরাধিকার সূত্রে বাংলাদেশ পায় ২,৮৫৮.৭৩ কিলোমিটার রেলপথ ও ৪৬৬টি স্টেশন।
১৯৯৬-২০০৩ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে বাংলাদেশ রেলওয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো সংস্কারের উদ্যোগ নেয় তৎকালীন সরকার। ১৯৯৮ সালে বর্তমান ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যমুনা নদীর ওপর বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধন করেন। এটি একটি সড়ক ও রেল সেতু। এ সেতুর কারণে বাংলাদেশের পূর্ব ও পশ্চিমে সরাসরি রেল যোগাযোগ শুরু হয়। সবশেষ ২০০৮ সালে ১৪ এপ্রিল মৈত্রী এক্সপ্রেস ট্রেন চালুর ফলে ঢাকা ও কলকাতার মধ্যে সরাসরি রেল যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজের যুগে বাংলাদেশ
অবিভক্ত ভারত সরকার আসাম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড ও উত্তরবঙ্গের সঙ্গে কলকাতার যোগাযোগ সহজ করতে এই ব্রিজ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ১৯১০-১১ সালে ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯১৫ সালের ৪ মার্চ অবিভক্ত ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি উদ্বোধন করেন। তার নামেই ব্রিজটির নামকরণ করা হয় ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’।
লোকোমোটিভ বা রেল ইঞ্জিন
ব্রিটিশ ডব্লিউজি বাগলান লিমিটেড নামের একটি কারখানায় ১৯৩৬ সালে কয়লাচালিত ন্যারোগেজ বাষ্পীয় লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন তৈরি করে। ১০ ফুট ৬ ইঞ্চি উচ্চতা আর ১৯ ফুট দীর্ঘ ইঞ্জিনটির ওজন ১১ দশমিক ৭৬ টন। খুলনা-বাগেরহাট রুটে কয়লাচালিত ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন চলাচল করত। সর্বশেষ ১৯৩৬ থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত চলাচল করেছে এই কয়লাচালিত ন্যারোগেজ স্টিম লোকোমোটিভ।
রেলের ইতিহাস বহন করা আরেকটি ইঞ্জিন হলো কয়লা চালিত ব্রডগেজ বাষ্পীয় লোকোমোটিভ বা ইঞ্জিন এসজিসি-জেড ২৪০। এটি ৫৩ ফুট ১০ ইঞ্চি লম্বা। এ ইঞ্জিন দিয়ে পাকশী রুটে ট্রেন চলাচল করত। ১৯৩৭ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত চলাচলের উপযোগী ছিল এ ইঞ্জিন। সময়ের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রেলের ইঞ্জিনেও আসতে থাকে পরিবর্তন। কয়লাচালিত ইঞ্জিনের পরিবর্তে আসতে থাকে ডিজেলচালিত মিটারগেজ ইঞ্জিন।
১৯৫৩ সালে কানাডার তৈরি ‘ইএমডি বি১২’ মডেলের ২০০০ শ্রেণির মিটার গেজ লোকোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ডিজেল লোকোর সূচনা হয়। রেলে ডিজেল লোকোর চাহিদা ও ব্যবহার বাড়তে থাকে। বাষ্পচালিত লোকোর ব্যবহার ধীরে ধীরে কমতে থাকায় ১৯৮০-এর দশকে সকল বাষ্পচালিত লোকো বাতিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে কিছু বাষ্পচালিত লোকো সংরক্ষণ করা হয়েছে।
১৯৯৬-৯৭ সালে দেশে মোট ২৮৪টি লোকোমোটিভ ছিল। ২০০৫ সালের ৩০শে জুন পর্যন্ত দেশে মোট ২৫৩টি ডিজেল ইলেক্ট্রিক (৬৮টি বিজি ও ১৮৫টি এমজি) এবং ৩৩টি ডিজেল-হাইড্রোলিক (১০টি বিজি ও ২৩টি এমজি) লোকোমোটিভ ছিল।
বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্যমতে, বর্তমানে রেলের বহরে ইঞ্জিন(লোকোমোটিভ) রয়েছে ২৬৩টি। এর মধ্যে ১৭১টি মিটার গেজ ও ৯২টি ব্রড গেজ ইঞ্জিন। ব্রড গেজ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে ৪৩টি বা ৪৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। এগুলোর মধ্যে ১৭টির আয়ুষ্কাল ৫০ বছরের বেশি, ১৪টির বয়স ৪০ বছরের বেশি ও ১২টির আয়ুষ্কাল ৩০ বছরেরও বেশি। ২০ বছরের কম ব্যবহৃত হয়েছে এমন ইঞ্জিন রয়েছে ৪৯টি।
প্রচলিত ইঞ্জিনে চলবে না মেট্রোরেল। বরং কোচের নিচে চাকার কাছে থাকবে মোটর লাগানো। বিদ্যুতে মোটর ঘুরবে এবং রেল তার আপন গতিতে চলবে।
সবশেষ
যমুনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার দূরে কাজ চলছে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর। ইতোমধ্যে এ রেল সেতুর ৪২ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ঢাকা ও উত্তরবঙ্গের ২২টি জেলার সঙ্গে ট্রেন চলাচল সহজ করতে যমুনা নদীর ওপর পৃথক রেল সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। এ রেল সেতুর কাজ সম্পন্ন হলে, এটি আন্তঃএশিয়া রেল যোগাযোগে মাইলফলক হিসেবে কাজ করবে।