নিউজ ডেষ্ক- ঢাকার পোস্তা বা আমিন বাজারে একটি গরুর চামড়া (৪৫ বর্গফুট) সর্বোচ্চ ১১শ থেকে ১২শ টাকায় কিনছেন আড়ত মালিকরা। এর সঙ্গে লবণ খরচ ৩শ টাকা। এ হিসাবে প্রতি বর্গফুটের ক্রয় মূল্য দাঁড়ায় ৩১ থেকে ৩৩ টাকা।
সংশ্লিষ্ট আড়ত মালিক এই চামড়া সরকারের বেঁধে দেওয়া দাম প্রতি বর্গফুট ৫২ টাকা হিসাবে বিক্রি করবেন ট্যানারি মালিকদের কাছে। এতে প্রতি বর্গফুট চামড়ায় আড়তদারের মুনাফা থাকবে সর্বোচ্চ ১৯ টাকা।
৪৫ বর্গফুট একটি গুরুর চামড়ায় লাভ দাঁড়াবে ৮৫০-৮৫৫ টাকা। অথচ দেড় লাখ টাকায় গরু কিনেও কুরবানিদাতা চামড়া বিক্রি করে পেয়েছেন ৫০০-৬০০ টাকা। এতে বঞ্চিত হয়েছেন অসহায়-দুস্থ মানুষগুলো। মূলত কুরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা দুস্থদের মাঝেই বিলিয়ে দেওয়া হয়।
জানা গেছে, গত ৩ দিনে সারা দেশে পশুর কাঁচা চামড়া বাণিজ্যে বাম্পার মেরেছেন আড়ত মালিকরা। আর প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত হয়েছেন কুরবানিদাতারা। তবে লোকসান গুনতে হয়নি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের।
সরকার গত কয়েক বছর পর এবার কাঁচা চামড়ার ক্রয়মূল্য বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু সুবিধার সবটুকু গেছে আড়ত মালিকদের কাছে। এর কারণ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কাঁচা চামড়ার নয়, লবণ মেশানো চামড়ার মূল্য বেঁধে দিয়েছে। লবণ মেশানো চামড়া কেনাবেচা হয় আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের মধ্যে। যা শুরু হবে আগামী সপ্তাহ থেকে। কিন্তু সারা বছরের মোট চাহিদার ৬০ শতাংশ লবণ ছাড়া চামড়া কেনাবেচা হয়েছে গত ৩ দিনে। কিন্তু সেখানে কোনো মূল্য বেঁধে দেওয়া ছিল না। ফলে আড়ত মালিকরা এক ধরনের সিন্ডিকেট করেই নিজেদের মতো চামড়া কিনেছেন।
গরুর পাশাপাশি এ বছর খাসির চামড়ায় ধস নেমেছে। পানির দরে এটি বিক্রি হয়েছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তবে এ বছর পুরান ঢাকার পোস্তায় কাঁচা চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।
চামড়া সংরক্ষণ, পরিবহণ ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত সাপ্লাই চেইন সচল রাখার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক তদারকি করতে সরকার গঠন করেছে কন্ট্রোল সেল। এই সেলের প্রধান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মালেকা খায়রুন্নেছা মঙ্গলবার যুগান্তরকে বলেন, চামড়ার বাজার স্বাভাবিক ছিল। কোনো ধরনের সমস্যা নিয়ে কেউ কোনো অভিযোগ করেননি। লবণের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল। সবমিলে এবার বাজার ভালো আছে।
বেঁধে দেওয়া মূল্য থেকে কমে বেচাকেনা : ঢাকায় গড়ে ছোট চামড়া ৩শ-৪শ টাকা, মাঝারি আকারে ৫শ-৭শ টাকা এবং বড় আকারে সাড়ে ৮শ থেকে এক হাজার টাকা বেচাকেনা হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রামে গড়ে ২শ থেকে ৫শ টাকায় চামড়া কেনাবেচা হয়েছে। কিন্তু সরকার যে মূল্য বেঁধে দিয়েছে ওই হিসাবে উলিখিত মূল্য প্রায় অর্ধেক।
চামড়া সংরক্ষণ, পরিবহণ ক্রয়-বিক্রয়সংক্রান্ত সাপ্লাই চেইন সচল রাখার লক্ষ্যে সার্বক্ষণিক তদারকি করতে সরকারের গঠিত সমন্বয় ও মনিটরিং কমিটির প্রধান এএইচএম সফিকুজ্জামান জানান, পোস্তায় প্রকার ভেদে ৭শ থেকে ৯শ টাকা পর্যন্ত চামড়া কেনা হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিবছরের মতো এবারও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের অভিযোগ দাম না পাওয়ার। সরকার আগেই লবণযুক্ত চামড়ার দর বেঁধে দিয়েছে। এখন কেউ যদি ব্যবসা না বুঝে মাঠপর্যায়ের কাঁচা চামড়া লবণযুক্ত চামড়ার দামেই কেনেন, তাহলে তো সেটি তার ব্যবসায়িক অজ্ঞতা। তিনি আরও বলেনÑঢাকার বাইরে নাটোর, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, খুলনাসহ সারা দেশে ভোক্তা অধিকারের টিম মনিটরিং করছে। আজও মনিটরিং কার্যক্রম চলমান থাকবে।
পোস্তায় চামড়া কম সংগ্রহ : অন্যান্য বছরে তিন লাখ পিস চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী পোস্তার চামড়ার আড়তগুলোতে। কিন্তু এ বছর এক লাখ পিস সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ৮০ শতাংশ পূরণ হয়েছে। তবে এবারে পোস্তায় চামড়া কম আসায় সেখানে যে সাড়ে তিনশ আড়তদার আছেন তারা তাদের চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য পূরণ করতে পারবেন কিনা সে আশঙ্কায় আছেন। পোস্তায় ভিড় কম হওয়ার পেছনে আড়তদাররা মনে করছেন সাভার ও হেমায়েতপুরের ট্যানারি ব্যবসায়ীদের অনেকে নিজেদের অর্থ দিয়ে সরাসরি চামড়া সংগ্রহ করেছেন।
আড়ত মালিক মোহাম্মদ সিরাজ জানান, এবারের ব্যবসা ভালো নয়। আমরা চামড়া প্রিজার্ভ করতে লবণ ও লেবার রেখেছি। এগুলোর পেছনে খরচ করেছি। কিন্তু আমাদের এখানে চামড়া আসছে কম। ব্যবসায়ীদের মতে, ট্যানারির মালিকরা সরাসরি ক্রয় করছেন। পোস্তার তুলনায় আমিনবাজারে চামড়া বেশি যাওয়ার মূল কারণ সাভারে ট্যানারি শিল্প গড়ে উঠা।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আফতাব খান জানান, পোস্তায় কমপক্ষ ৮০ হাজার পিস চামড়া ঢুকেছে বলে আমার ধারণা।
পাচার প্রতিরোধে সীমান্তে নজরদারি : অবৈধপথে ভারতে কুরবানির পশুর চামড়া পাচার রোধে সাতক্ষীরা সীমান্তে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারির পাশাপাশি বাড়ানো হয়েছে টহলও। সীমান্তের কার্যক্রম সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করছেন বিজিবির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।
সাতক্ষীরায় বিজিবির তিনটি ব্যাটালিয়নের অধীনে সীমান্ত এলাকা রয়েছে ২৭৮ কিলোমিটার। এ দীর্ঘ সীমান্তের প্রায় ৩০টি চোরা ঘাট দিয়ে মানব পাচার ও চামড়াসহ বিভিন্ন পণ্য চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট। ঈদুল আজহার সময় এসব সিন্ডিকেটের সদস্যরা তৎপর বলে জানিয়েছে সীমান্তের স্থানীয় বাসিন্দারা।
বর্তমানে দেশে ২২০টি ট্যানারির মধ্যে ১৫৪টি সচল আছে। এসব ট্যানারির ৬০ শতাংশের জোগান আসে প্রতিবছর কুরবানির মৌসুমে। এর মধ্যে গরুর চামড়া মেলে ৪৫ থেকে ৫০ লাখ। খাসি, ছাগল, মহিষ ও ভেড়ার চামড়া মেলে ৩৫ থেকে ৪০ লাখ। প্রতিবছর ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া প্রক্রিয়াজাত হয় এসব ট্যানারিতে।