পাথর উত্তোলনের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট

জাতীয়

নিউজ ডেষ্ক- গ্রানাইট খনিতে পাথর উত্তোলনের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাটের দুর্নীতি ধামাচাপা দেওয়ার পাঁয়তারা চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) নিজস্ব অনুসন্ধানে ১৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এজন্য পৃথক ৪টি মামলার সুপারিশ করে অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। প্রায় ১০ মাস আগে দেওয়া ওই প্রতিবেদনে ৪ মামলায় পেট্রোবাংলা, বাপেক্স ও গ্রানাইট খনির এক ডজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আসামির সুপারিশ করা হয়।

তবে বিষয়টি সুরাহা না করেই ফের তদন্তের জন্য দুদক থেকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কমিশনের এমন কর্মকাণ্ডকে প্রভাবশালীদের ছাড় দেওয়ার পাঁয়তারা বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বছর বছর চুনোপুঁটি ধরা ছাড়া রাঘব বোয়ালদের ধরে বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতি কমিশনের নজর একেবারেই কম।

৬ ফেব্রুয়ারি দুদকের অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির আহ্বায়ক মহাপরিচালক একেএম সোহেল স্বাক্ষরিত এ সংক্রান্ত একটি চিঠি সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে বলা হয়, ‘উক্ত বিষয়ে প্রাপ্ত অভিযোগটির ওপর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিবের কাছে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন চাওয়ার জন্য কমিশনে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এমতাবস্থায় কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুসারে ২০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্তপূর্বক প্রতিবেদন দাখিলের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দেওয়া হলো।’

মন্ত্রণালয়কে এমন দায়িত্ব দেওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে দুদকের মহাপরিচালক একেএম সোহেল বলেন, কমিশনের যে কোনো বিষয়ে কথা বলার জন্য কমিশন সচিব রয়েছেন। তিনি সব বিষয়ে কথা বলার জন্য কমিশন কর্তৃক নির্ধারিত। এ বিষয়ে জানলেও আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। কমিশনের সচিবের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি।

এরপর দুদকের চিঠির বিষয়ে বিস্তারিত জানালে কমিশনের সচিব মো. মাহবুবু হোসেন এ ব্যাপারে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।

জানতে চাইলে দুদকের সাবেক মহাপরিচালক (লিগ্যাল) ও সাবেক জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, অভিযোগটি অনুসন্ধান শেষে অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেছেন। যদি ওই প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ হয়, তাহলে কমিশন মামলার অনুমোদন দিতে পারে। আর পূর্ণাঙ্গ না হলে অধিকতর অনুসন্ধানের জন্য কোয়ারি দিতে পারে। যেহেতু এখানে দুর্নীতির প্রশ্ন জড়িত, এখানে মন্ত্রণালয় দিয়ে তদন্ত করালে বিধিরও ব্যত্যয় ঘটবে। যা আইনানুগ হবে না।

জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এখানে দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়ার পরই দুদক সেই অনুসন্ধান শুরু করেছে। ফলে অভিযোগটির অনুসন্ধানের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর কোনো যৌক্তিকতা নেই। এখানে প্রভাবশালী মহল জড়িত বলেই এমন করা হচ্ছে বলে প্রশ্ন উঠা স্বাভাবিক। কমিশনকে সব প্রভাবমুক্ত হয়ে কাজ করতে হবে। দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধানের জন্যই দুদক সৃষ্টি হয়েছে। এ অভিযোগটি মন্ত্রণালয় নয়, দুদককেই অনুসন্ধান কার্যক্রম শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্যই বলা হয়ে থাকে, দুদক শুধু চুনোপুঁটি নিয়ে নাড়াচাড়া করে। রাঘব বোয়ালের দিকে তাদের নজর নেই বললেই চলে।

অভিযোগে যা আছে : মধ্যপাড়া খনিটির দায়িত্বে নিয়োজিত পেট্রোবাংলার অঙ্গসংগঠন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির সঙ্গে জার্মানিয়া ট্রেস্ট কনসোর্টিয়াম (জিটিসি) নামক এক কোম্পানি একটি চুক্তির মাধ্যমে বর্তমানে খনি পরিচালনা ও পাথর উত্তোলনের কাজে নিয়োজিত রয়েছে। কিন্তু খনি পরিচালনা ও উত্তোলন কর্মকাণ্ডে এ কোম্পানির অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনার কারণে গত পাঁচ বছরে কঠিন শিলা উত্তোলনে ধস নামে। ছয় বছর মেয়াদি চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কোম্পানিটির মোট ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে দেওয়ার কথা।

কিন্তু চুক্তিবদ্ধ সময়ের শেষ বছরে কোম্পানিটি মাত্র ৩০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করেছে। উত্তোলনের কাজের নিু ধারা চুক্তিবদ্ধ সময়ের দ্বিতীয় বছরেই ফুটে ওঠে। চুক্তি অনুযায়ী ১৪ লাখ টন পাথর উত্তোলনের কথা থাকলেও উত্তোলিত হয় ৫ লাখ টন। তৃতীয় বছর ১৬ লাখ টন পাথর উত্তোলনের স্থলে উত্তোলন করা হয় মাত্র ১ লাখ টন এবং চতুর্থ বছরে ১৭ লাখ টনের স্থলে উত্তোলন করা হয় মাত্র ৪ লাখ টন। অধিকন্তু চুক্তিবদ্ধ সময়ের মধ্যে প্রায় এক বছরের বেশি সময় পাথর উত্তোলন বন্ধ থাকে। মধ্যপাড়া খনি কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, চুক্তিবদ্ধ সময়ে নির্দিষ্ট পরিমাণ পাথর উত্তোলন করে না দেওয়ার ফলে রাষ্ট্রীয় ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ৬০০ কোটি টাকা।

২০১৪ সাল থেকে খনিটি পরিচালনা ও পাথর উত্তোলনের দায়িত্ব একটি চুক্তির মাধ্যমে জিটিসিকে দেওয়া হয়। কোম্পানিটির সঙ্গে সম্পাদিত ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার চুক্তি অনুযায়ী খনিটিতে ৬ বছরে ১২টি স্টোপ নির্মাণ করে, তা থেকে মোট ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু জিটিসি কোম্পানি প্রথম থেকেই কর্তব্যে অবহেলা ও চুক্তির ধারা তোয়াক্কা না করে সময়ক্ষেপণ করে। এছাড়া চুক্তিবদ্ধ ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিভিন্ন খাতের পাওনা ইতোমধ্যেই জিটিসি কোম্পানি কখনো চাটুকারের আশ্রয় নিয়ে, কখনো বা বিশেষ মহলের মাধ্যমে চাপ সৃষ্টি করে হাতিয়ে নিয়েছে। অথচ তার বিপরীতে যে ৯২ লাখ টন পাথর উত্তোলন করে দেওয়ার কথা, তার মধ্যে শুধু ৩০ লাখ টন পাথর উত্তোলন করা হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে যা পাওয়া গেছে : ২০১৯ সালের জুলাইয়ে এ অভিযোটির অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। দীর্ঘ অনুসন্ধান শেষে প্রায় ১০ মাস আগে পৃথক ৪টি মামলার সুপারিশ করে কমিশনে প্রতিবেদন দাখিল করেন অনুসন্ধানকারী কর্মকর্তা। চার মামলার সুপারিশে মোট ১৬৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে মোট ১৩ জনকে আসামির সুপারিশ করা হয়েছে। অনুসন্ধান প্রতিবেদনে প্রথম মামলার সুপারিশে ১০২ কোটি ২২ লাখ ৪৪ হাজার ৪১৩ টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ১১ জনকে আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছে।

দ্বিতীয় মামলায় ২৮ কোটি ৪ লাখ ৩ হাজার ৮৫৭ টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের অভিযোগ করা হয়েছে। এখানে ৫ জনকে আসামির সুপারিশ করা হয়েছে। তৃতীয় মামলায় ২৩ কোটি ৩৫ লাখ ৭৩ হাজার ১২৫ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এ মামলায় ৫ জনকে আসামির সুপারিশ করা হয়েছে। চতুর্থ মামলায় ১১ কোটি ৪৪ লাখ ৫৪ হাজার ৭১৬ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়েছে। এতে ৬ জনকে আসামির সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিটি মামলার সব আসামিই বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা), বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিডেট (বাপেক্স) এবং মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।

এসব মামলায় যাদের আসামির সুপারিশ করা হয়েছে তারা হলেন- রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ড. মো. সিরাজুল ইসলাম কাজী, পেট্রোবাংলার পরিচালক (পিএসসি) মোহাম্মদ আবুল বাশার, অবসরপ্রাপ্ত পরিচালক (পরিকল্পনা) মো. আমিনুজ্জামান, অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. মাহমুদ খান, বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর মো. আব্দুল হান্নান, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির অবসরপ্রাপ্ত মহাব্যবস্থাপক মো. আসাদুজ্জামান, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আতিয়ার রহমান, উপ-মহাব্যবস্থাপক সৈয়দ রফিকুল ইসলাম, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. উবায়দুল্লাহ, উপ-মহাব্যবস্থাপক মো. আব্দুল মাজেদ, মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবিএম কামরুজ্জামান ও ব্যবস্থাপক সুদীপ্ত পাল। এদের মধ্যে প্রায় সবাইকে একাধিক মামলায় আসামি করার সুপারিশ করা হয়েছে।

দুদকের অনুসন্ধানে বাদ পড়েছেন যারা : কমিশনে অনুসন্ধান প্রতিবেদন জমা পড়ার পর ২০২১ সালের ১৪ জুন মধ্যপাড়া গ্রানাইট মাইনিং কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপক (ইউজিএম) মো. আল মামুন দুদকে একটি লিখিত অভিযোগ জমা দেন। সেখানে বলা হয়, চুক্তি অনুযায়ী উৎপাদিত পাথরে ডাস্টের সর্বোচ্চ গ্রহণযোগ্য মাত্রা ৮ শতাংশ।

কিন্তু বাস্তবে চুক্তি শুরু থেকে অদ্যাবধি পাথরে ডাস্টের পরিমাণ ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ। বিষয়টি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদে উত্থাপিত হলে পর্ষদের ২০৪তম সভায় পরিচালনা পর্ষদ অতিরিক্ত ডাস্টের জন্য ঠিকাদারের বিল কর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু এরপর সেই অতিরিক্ত অর্থ কর্তন করা হয়নি। এজন্য ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও ইটিসিরা (ইঞ্জিনিয়ার টু কনটাক) দায়ী। ঠিকাদার ৩য়, ৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ বছরে পাথর উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারলে চুক্তি অনুযায়ী ঠিকাদারের কাছ থেকে এলডি (লিকুইডিটিটি ড্যামেজ) আদায় করতে হবে। কিন্তু ঠিকাদার লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী পাথর উৎপাদন না করলেও এক্ষেত্রে কোনো এলডি আদায় করা হয়নি।

চুক্তি অনুযায়ী পাথর উৎপাদিত হচ্ছে মাত্র ৪৪ শতাংশ। কিন্তু মূল্য পরিশোধ করা হয়েছে ১০০ শতাংশ। এই অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের জন্য সংশ্লিষ্ট এমডি, ইটিসি ও পরিচালনা পর্ষদ দায়ী। চতুরতার সঙ্গে চুক্তিটি এমনভাবে করা হয়েছে যে খনি থেকে কোনো পাথর উত্তোলন না করে বা খনিতে কোনো কাজ না করেই ‘টেকনোলজি মডিফিকেশনের’ নামে একটি ড্রয়িং দাখিল করে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এজন্য চুক্তি প্রণয়ন কমিটি, পরামর্শক ও পরিচালনা পর্ষদ দায়ী। সেখানে আরও বলা হয়, দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে মূল অভিযুক্তদেরই বাদ দেওয়া হয়েছে। এরা হলেন-মহাব্যবস্থাপক আবু তালেব ফরাজী, ফজলুর রহমান, সাবেক এমডি এসএমএন আওরাঙ্গজেব, নওশাদ ইসলাম, নাজমুল হায়দার, জাভেদ চৌধুরী, পরামর্শক আমিনুর রহমান ও পরিচালনা পর্ষদ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *