নিউজ ডেষ্ক- নিত্যপণ্য মূল্যে প্রতিযোগী এবং উন্নত দেশগুলোকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। ভোজ্যতেল, ডিম ও পেঁয়াজসহ কয়েকটি পণ্যের দাম ইউরোপ-আমেরিকাকেও ছাড়িয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে এসব পণ্যের দাম বাড়ানো হচ্ছে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই দাম বৃদ্ধি বাস্তবসম্মত নয়। এর অন্যতম কারণ বাজার ব্যবস্থায় ব্যর্থতা। সামগ্রিকভাবে অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর এখনই এসব পণ্যের লাগাম টেনে ধরতে না পারলে রমজানে আরও বাড়বে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, নিত্যপণ্যের দামে এরইমধ্যে নাভিশ্বাস উঠেছে। এক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে কিছু পণ্যের দাম বাড়ছে।
সাধারণত বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে দেশে ব্যবসায়ীরা এর সুযোগ নেয়। অর্থনীতির ভাষায় একে বলে প্রত্যাশিত মূল্যস্ফীতি। অর্থাৎ দাম বাড়বে, এই কারণে পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। তিনি বলেন, এখানে বাজার ব্যবস্থার ব্যর্থতা রয়েছে।
একশ্রেণির ব্যবসায়ী বাজারকে জিম্মি করে ফেলে। এদেরকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি বলেন, সামনে রমজান। রমজানকে কেন্দ্র করে কারসাজি চক্র সক্রিয় হয়ে ওঠে। ফলে এদেরকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। পাশাপাশি পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার উদ্যোগ নিতে হবে।
মানুষের আয়ের সঙ্গে মিলিয়ে কয়েকটি পণ্যের তুলনামূলক পর্যালোচনা করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ঢাকায় একজন মানুষের মাসিক গড় আয় ১৪৯ মার্কিন ডলার।
কিন্তু এক লিটার দুধের দাম ৮০ টাকা, এক ডজন ডিম ১১০ টাকা এবং এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৫৫ টাকা। কিন্তু চেক রিপাবলিকের অস্ট্রাবা শহরের মানুষের মাসিক গড় আয় ১৩৩১ ডলার। সেখানে প্রতি লিটার দুধের দাম ৬২ টাকা।
স্পেনের মালাগা শহরে একজনের মাসিক আয় ২২২৭ ডলার। সেখানে দুধের লিটার ৬২ টাকা। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওহিও রাজ্যের ডেটন শহরে একজন নাগরিকের মাসিক আয় ৩৯৫৫ ডলার, যা বাংলাদেশের চেয়ে ২৭ গুণ বেশি।
কিন্তু সেখানে এক ডজন ডিম ১০৩ টাকা। অর্থাৎ আয় ২৭ গুণ বেশি হলেও ডিমের দাম প্রতি ডজনে ৭ টাকা কম। মালয়েশিয়ার সেলানগর শহরের মানুষের মাসিক গড় আয় ৬৬৯ ডলার। সেখানে প্রতি ডজন ডিম ৮৫ টাকা।
সার্বিয়ার বেলগ্রেড শহরে একজনের মাসিক গড় আয় ৩৩৫ ডলার। সেখানে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৪০ টাকা। আজারবাইজানের বাকু শহরে প্রতি নাগরিকের মাসিক গড় আয় ৩০৭ ডলার। সেখানে প্রতিকেজি পেঁয়াজের দাম ৩৭ টাকা।
অর্থাৎ উন্নত দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম বেশি। সিপিডির গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মানুষ সাধারণত তিন ধরনের চাল খায়। এগুলো হলো- মিনিকেট, পাইজাম এবং মোটা চাল।
তিনটির দামই ঊর্ধ্বমুখী। সেক্ষেত্রে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামের চেয়ে বাংলাদেশে চালের দাম বেশি। কিন্তু এসব দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চালের উৎপাদন বেশি। ময়দা ও ভোজ্যতেলের ক্ষেত্রে এটি আরও বেশি।
এছাড়াও চিনি ও গরুর মাংসের দাম অন্যান্য বাজারের চেয়ে ঢাকার বাজারে বেশি। এ ব্যাপারে রোববার সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, বর্তমানে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারের সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত।
তিনি বলেন, আমরা কয়েকটি দেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখেছি, আয়ের দিক থেকে আমরা পিছিয়ে কিন্তু পণ্যের দাম বাংলাদেশে বেশি। এর মানে হলো এখানে বাজার ব্যবস্থাপনায় সমস্যা রয়েছে। মার্কেট ইন্টেলিজেন্স বা বাজার তদারকির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া দরকার।
এক্ষেত্রে সরবরাহ যাতে যথেষ্ট থাকে সে ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের ক্ষেত্রে মনোপলির (একচেটিয়া) প্রভাব কমিয়ে আনতে হবে। এক্ষেত্রে কারা এর সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা দেখেছি সংকটের সময় এসব চক্র অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে যায়।
অর্থাৎ সুযোগটাকে তারা ভালোভাবে ব্যবহার করে। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক আরও বলেন, সামনে রমজান মাস। আর প্রতিবছর রমজানে মানুষের চাহিদা বাড়ে। ওই সময়ে আমদানিকারক ও বিক্রেতারা কারসাজির মাধ্যমে মূল্য বাড়িয়ে দেয়। এদের বিরুদ্ধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে।
সাম্প্রতিক সময়ে দেশে অধিকাংশ নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর মধ্যে ভোজ্যতেল, চাল, চিনি, পেঁয়াজ, ডাল, ডিম এবং গরুর মাংস অন্যতম। ব্যবসায়ীরা বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দেশীয় বাজারেও প্রভাব পড়ছে।
আর বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেলের ওপর থেকে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) প্রত্যাহার করছে সরকার। তবে গবেষণা বলছে, এই দাম বৃদ্ধি যৌক্তিক নয়। এর কারণ বাজার ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতা।