নিউজ ডেষ্ক- করোনা মহামারি আর রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করেছে পুরো বিশ্বকে। খাদ্য জোগাতে লড়াই করছে বিভিন্ন দেশের কোটি কোটি মানুষ।
পৃথিবীর এই কঠিন দুঃসময়ে জলবায়ু পরিবর্তনও শস্য উৎপাদনে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য পূরণের পাশাপাশি কৃষি উৎপাদন ৫০ শতাংশ বাড়িয়ে প্রায় ৮০০ কোটি মানুষের খাদ্য সংস্থানের জন্য প্রয়োজন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ।
অন্য কথায় বলতে গেলে, অলৌকিকতা ছাড়া এ সংকট থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই। সেই অলৌকিকতার সন্ধান দিয়েছে বিকল্প প্রোটিন ও টেকসই কৃষি নিয়ে গবেষণা চালানো অকল্যান্ডভিত্তিক সংস্থা টেরভিভা।
তারা বলছে, বন্যা বা খরার মতো জলবায়ু দুর্যোগের মধ্যেও খাদ্য সংকটে নিমজ্জিত পৃথিবীর মানুষকে বাঁচাতে পারে ‘আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ’ পঙ্গামিয়া গাছ। সামান্য পুঁজিতে এর বীজ থেকে তৈরি মূল্যবান জৈব-জ্বালানিই বাঁচাতে পারে বিশ্বকে। ক্যানারি মিডিয়া।
টেরভিভা বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে যুদ্ধ করে শুষ্ক অনুর্বর জমিতেও অনায়াসে জন্মাতে এবং নির্বিঘ্নে বাড়তে পারে পঙ্গামিয়া। এই সুপার গাছের বীজ থেকে উৎপন্ন হয় পর্যাপ্ত পরিমাণ সয়াবিন ও জলপাই তেলের মতো এক প্রকার পুষ্টি ও তেলসমৃদ্ধ মটরশুঁটি।
যেখানে রাসায়নিক সারের দূষণে উর্বর কৃষিজমি এবং পানি দূষিত হয়ে পরিবেশকে দম বন্ধ অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে-সেখানে কোনো কীটনাশক বা সেচ ছাড়াই যেকোনো জমিতে সহজেই চাষ করা যায় এ গাছ। গাছগুলো বায়ুমণ্ডল থেকে অনেক বেশি নাইট্রোজেন শুষে নেয় বলে এতে সারের প্রয়োজন হয় না। যেখানে বর্তমান খাদ্যব্যবস্থা সব গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনের এক-তৃতীয়াংশের জন্য দায়ী, সেখানে ক্রমবর্ধমান নির্গমনকে হ্রাস করে এ গাছ। প্রতি একর জমির পঙ্গামিয়া পাঁচ টন কার্বন নির্গমন রোধ করে।
পঙ্গামিয়া চাষের জন্য ট্রাক্টরের মতো কৃষিযন্ত্রও ব্যবহার করতে হয় না। কোনো রকম মাটিতে ফেলে রাখলেই অনায়াসে হতে পারে স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাপ-সহনশীল, খরা-সহনশীল পঙ্গামিয়ার বাম্পার ফলন।
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে গাছটি হাজার হাজার বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়ার বিস্তীর্ণ বনাঞ্চলজুড়ে পড়ে আছে অযত্ন অবহেলায়, কেবল কাঠ উৎপাদনের মতো সাধারণ কাজেই এটিকে ব্যবহার করা হয়ে আসছে। আশার কথা হচ্ছে, এর গুরুত্ব অনুধাবনের পর যুক্তরাষ্ট্রে সুপার-ফসল হিসাবে পরিচিত হচ্ছে পঙ্গামিয়া। এটি নতুন বা বিরল কোনো গাছ নয়। প্রাচীন আয়ুর্বেদিক গ্রন্থে এর নিরাময় গুণগুলো উদ্ধৃত করা হয়েছে। এন্টিফাঙ্গাল তৈরিতে এ তেল ব্যবহৃত হয়। এর তেল করঞ্জা নামেও পরিচিত। ভারতে প্রাকৃতিক লুব্রিকেন্ট, বার্নিশ এবং বাতির তেল হিসাবে এ তেল ব্যবহৃত হয়। ছায়াযুক্ত গাছটির ছায়ায় বসে বিশ্রামও নেওয়া যায়। এর বিস্তৃত মূল তুমুল ঝড়েও সহজে গাছটিকে মাটিতে হেলতে দেয় না। বসন্তে ফোটে সাদা এবং গোলাপি ফুল। এরপর শিম বা মটরশুঁটির মতো সবজি বেরিয়ে আসে ফুল থেকে। পরিপক্ব শিম থেকে বেরিয়ে আসে তেলসমৃদ্ধ বীজ। যদিও এর তেলের স্বাদ কিছুটা তেঁতো, কোনো সুগন্ধ নেই। তাই এটিকে সরাসরি খাদ্য হিসাবে ব্যবহারের পরামর্শ দেয় না টেরভিভা।
তাহলে কীভাবে এটি জলবায়ু সংকট থেকে বাঁচিয়ে বিশ্বকে খাওয়ানোর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবে? নবিন সিক্কা নামে বার্কলের এক ব্যবসায়ী ২০০৯ সালে সালের মাঝামাঝি ভারত সফর করেছিলেন গাছটি টেকসই জৈব জ্বালানি তৈরি করতে পারে কি-না তা দেখতে। সিক্কা জানতেন জৈব জ্বালানির একটি গুরুতর নেতিবাচক দিক রয়েছে। আর তা হলো খাদ্য উৎপাদনের পরিবর্তে জ্বালানি বৃদ্ধির জন্য কৃষিজমি উজাড় করতে হয়।
তাহলে সেসব কৃষিজমির খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। এটি প্রতিস্থাপন না করা গেলে সেই খাদ্যের অভাব আর মেটে না।
তাছাড়া যে গাছগুলো কার্বনশূন্য করতে সহায়তা করার কথা, উলটো সেই গাছগুলো পুড়িয়ে কার্বনের পরিমাণ বাড়ানোর ঝুঁকিই নেওয়া হলো।
এ কারণে সিক্কা ভাবলেন, পঙ্গামিয়ার বীজ দিয়ে জৈব জ্বালানি তৈরি করা হলে বনের পর বন কিংবা হাজার হাজার একর কৃষিজমি উজাড় হওয়া থেকে বেঁচে যাবে। কৃষিজমি হারানোর পরিমাণ যত কমবে, খাদ্য উৎপাদন ততই বাড়বে। এভাবেই পৃথিবী থেকে একদিন তিরোহিত হবে খাদ্য সংকট নামের শব্দটি।
সিক্কার সফল মিশন থেকেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিয়েছে টেরভিভা। সংস্থাটি বলছে, বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ পঙ্গামিয়ার চাষই কেবল পৃথিবীর মানুষকে খাওয়াতে পারবে। কারণ, পরীক্ষা করে দেখা গেছে সয়াবিন ক্ষেতের তুলনায় ৪ থেকে ১০ গুণ বেশি ফলন দেয় পঙ্গামিয়া।
এ গাছের চাষে বিনিয়োগ করতে ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সংগ্রহ করেছে, কর্মী নিয়োগ করেছে শতাধিক। ভারতে বন্যভাবে বেড়ে ওঠা গাছগুলোতে ইতোমধ্যেই ১০ লাখ টনেরও বেশি বীজ রয়েছে। সেগুলোকে বাছাই করে সংগ্রহ করতে স্থানীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে নিয়োগ দিয়েছে টেরভিভা।