দ. আফ্রিকায় ১২ দিনে ৫ বাংলাদেশি প্রবাসী খুন

জাতীয়

সংসারের টানাপোড়েনের ইতি টানতে এবং উন্নত জীবনের আশায় প্রবাসে পাড়ি জমিয়েছিলেন। কিন্তু সেই আশা পরিণত হচ্ছে দুঃস্বপ্নে। দারুণ উচ্ছ্বাস নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানো মানুষগুলোর প্রাণ ঝরছে সন্ত্রাসীদের গুলিতে-ছুরিকাঘাতে। পরিবার ভাসছে শোকের সাগরে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় এভাবে প্রবাসী বাংলাদেশিদের হত্যা যেন নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১২ দিনে দেশটিতে সন্ত্রাসীরা পাঁচ বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে।

দক্ষিণ আফ্রিকার থাবানচু এলাকায় মুদি ব্যবসা করতেন মো. গোলাম মোস্তফা (৩২)। সন্ত্রাসীদের চাঁদা না দেওয়ায় এ বাংলাদেশি যুবককে গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে মালামাল নিয়ে পালিয়ে যায় একদল সশস্ত্র সন্ত্রাসী। গত ১৭ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সময় রাত পৌনে ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা তাকে হত্যা করে।

গোলাম মোস্তফা নোয়াখালীর সেনবাগ উপজেলার কাবিলপুর ইউনিয়নের জয়নাল আবদিন মেম্বারের ছোট ছেলে। ওইদিন রাতে তার মৃত্যুখবর গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালে শুরু হয় শোকের মাতম। মোস্তফার স্ত্রী ও দুই ছেলে রয়েছে।

মনির হোসেন ও তার মেঝো ভাই ইমদাদুল হক প্রায় ১০ বছর আগে উন্নত জীবনের আশায় পাড়ি জমান দক্ষিণ আফ্রিকায়। দেশটির প্রিটোরিয়া শহরে রড-সিমেন্টসহ নির্মাণ সামগ্রীর ব্যবসা বেশ ভালোই চলছিল। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে সন্ত্রাসীরা মনিরের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হানা দেয়। এসময় মনির বাধা দিলে দুর্বৃত্তরা তাকে গুলি করে হত্যার পর টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়।

মনির টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার তরফপুর ইউনিয়নের পাথরঘাটা গ্রামের পলান মিয়ার ছেলে। দক্ষিণ আফ্রিকায় ডাকাতের গুলিতে আহত হওয়ার পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি মৃত্যু হয় সাইফুল ইসলাম নামে বাংলাদেশি এক তরুণের। নোয়াখালীর মাইজদীর বাসিন্দা সাইফুল আফ্রিকার কুরমান এলাকায় নতুন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালুর এক মাসের মধ্যে গুলিবিদ্ধ হন। দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে ৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় কিম্বার্লি প্রাদেশিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি।

গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টায় বাণিজ্যিক রাজধানী জোহানেসবার্গের বেননী এলাকায় নিজ বাসায় ডাকাতের গুলিতে খুন হন মীর হোসেন মিরাজ নামে আরেক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী।

অস্ত্রের মুখে মিরাজের বাসায় থাকা অন্যান্য সদস্যদের বাথরুমের মধ্যে আটকে রেখে নগদ অর্থ, মূল্যবান জিনিসপত্র ও ব্যাংকের কার্ড নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ডাকাত দল মিরাজের বুকে ও মাথায় বেশ কয়েক রাউন্ড গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করে পালিয়ে যায়।

মিরাজের এক ঘনিষ্ঠ আত্মীয় জানিয়েছেন, তার কোনো শত্রু ছিল না। এই হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত। সবশেষ গতকাল শুক্রবার (১৮ ফেব্রুয়ারি) দেশটির প্রিটোরিয়া সংলগ্ন হামাসক্রালে মো. হাসান নামে আরেক বাংলাদেশিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। রাত ১০টার দিকে কয়েকজন ডাকাত দোকানে প্রবেশ করে হাসানকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করলে ঘটনাস্থলে মৃত্যুবরণ করেন তিনি। পরে ডাকাত দল দোকানের নগদ টাকা ও মূল্যবান জিনিস নিয়ে পালিয়ে যায়।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নব্বই এর দশক থেকে বাংলাদেশের মানুষ দক্ষিণ আফ্রিকায় কাজের সন্ধানে যেতে শুরু করেন। দেশটিতে বৈধভাবে এক লাখের মতো বাংলাদেশি রয়েছেন। দেশটিতে এখনো শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য ব্যাপক এবং ভূমির মালিকানা নিয়েও রয়েছে চরম অসন্তোষ।

সেই সঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে দেশটিতে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে, স্থানীয়দের মধ্যে বেকারত্বের হার ২৮ শতাংশ। কর্মসংস্থান না থাকায় কেপটাউন এবং জোহানসবার্গসহ বড় শহরগুলোর অপরাধ প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়া দেশটির একটি বড় সমস্যা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশি কমিউনিটির এক নেতা বলেন, প্রবাসীদের মালিকানাধীন দোকানপাটে হামলা এবং লুটতরাজ প্রায় নিয়মিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কেপটাউন, জোহানসবার্গ, প্রিটোরিয়া এবং ব্লুমফন্টেইনে অভিবাসী বিরোধী হামলার শিকার হয়েছেন বহু বাংলাদেশি।

তিনি বলেন, এখানে আমরা প্রতিনিয়ত যে সমস্যায় আতঙ্কিত হয়ে উঠেছি তার নাম ‘কিডন্যাপ’। আর এ শব্দের সঙ্গে এ দেশের কালো বা সাদা কেউ অতটা পরিচিত ছিল না। কিছু বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানি এ জঘন্য ঘৃণিত কাজে লিপ্ত। তাই আমাদের চলাফেরা ও কথাবার্তায় সতর্ক থাকতে হবে। আর যদি কাউকে সন্দেহ হয়, তার প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। একা চলার অভ্যাস পরিহার করতে হবে।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *