টিকটকে ভয়ংকর হচ্চেন দেশের কিশোররা

বাংলাদেশ

সভ্যতার উন্নয়নে তথ্যপ্রযুক্তির অবদান অনস্বীকার্য। প্রযুক্তি আমাদের অনেক কিছু শিখিয়েছে। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া যেন কোনা কিছু চিন্তাই করা যায় না। তবে এর অপব্যবহার আমাদের সমাজ থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কেড়ে নিয়েছে। বিভিন্ন বয়সী মানুষ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির অপব্যবহারে অন্ধকার জগতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছে কিশোররাও।

জনপ্রিয় সংক্ষিপ্ত ভিডিও তৈরির অ্যাপ টিকটক। অপব্যবহার হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগের এ মাধ্যমটিও। টিকটকের মাধ্যমেই অপরাধ জগতে প্রবেশ করছে কিশোররা। এতে খালি হচ্ছে অসংখ্য মায়ের বুক। কিশোরী ও তরুণীরা তাদের সম্ভ্রম হারাচ্ছেন।

বয়স ১৬ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। পরনে দেড়শ টাকা দামের গেঞ্জি। ছয়শ টাকার জিন্স প্যান্ট। হাতে একটি দামি মোবাইল। দাম কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা। তারা বখাটে নয়; কিন্তু কিশোর গ্যাং। কর্মজীবী। কেউ প্রিন্টিং কারখানা, কেউ গার্মেন্টস আবার কেউ ডাইং কারখানায় চাকরি করে। দলবেঁধে চলতে পছন্দ করে এবং চলে। সপ্তাহ শেষে একটি দিন ওরা দলবেঁধে ঘুরে বেড়ায়। সেই অবকাশ সময়ে ‘টিকটক’ ভিডিও চিত্র তৈরি করে ফেসবুকে ছাড়ে। বন্ধুদের শেয়ার করে। কর্মজীবী এ কিশোর গ্যাং সদস্যরা গরিব ঘরের সন্তান। কিন্তু বেশভূষায় তার ছাপ নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ শহরে ওরা ভাসমান। কোনো আত্মীয়ের বাসায় থাকে কিংবা কোনো মেসবাড়িতে থাকে। এদের বেশিরভাগই জামালপুর, নাটোর, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, মাগুরা, যশোর ও রংপুর থেকে আসা। তাদের বসবাস বেশি শিল্প এলাকায়।

বুধবার (২ ফেব্রুয়ারি) টিকটক ভিডিও বানানোর জন্য এক কিশোরীকে (মাদরাসাছাত্রী) তার নানিবাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যায় কথিত প্রেমিকসহ পাঁচ টিকটকার। কলাগাছিয়া ইউনিয়নের সাবদী এলাকায় তারা রাত পর্যন্ত টিকটক ভিডিওর শুটিং করে। রাত সাড়ে ৯টার দিকে ইস্পাহানি মাঝির গল্লী এলাকার নির্জন জায়গায় নিয়ে কথিত প্রেমিক ওই কিশোরীকে ধর্ষণ করে। ধর্ষণের সময় চার সহযোগী ঘটনাস্থল পাহারা দেয়। এসময় এলাকাবাসী ধর্ষণের বিষয়টি আঁচ করতে পেরে তিন সহযোগীকে আটক করে। সেসময় কৌশলে প্রেমিক ও দুই সহযোগী পালিয়ে যায়। পরে কথিত প্রেমিককে গ্রেফতার করে পুলিশ। তাদের সবার বয়স ১৫ থেকে ১৬ বছরের মধ্যে।

গত ২৮ জানুয়ারি রাতে ফতুল্লার মাসদাইর এলাকায় দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে নিহত হয় কিশোর আমান আলী (১৭)। এ ঘটনায় মামলা করার আগেই সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেফতার করা হয় ৬ কিশোরকে। তারা সবাই আমানের সহকর্মী ও বন্ধু হিসেবে পরিচিত। বিভিন্ন গার্মেন্টস ও প্রিন্টিং কারখানায় তারা কর্মরত। তবে এ মামলায় তারাই জড়িত কি-না তা এখনো নিশ্চিত নয় পুলিশ। কিন্তু তাদের দৈনন্দিন পরিকল্পনা ও কার্যক্রম দেখে চোখ কপালে উঠেছে তদন্তকারী কর্মকর্তাদের।

শুরুতে পরিবারের সন্দেহ থেকেই আমানের সঙ্গে চলাফেরা করে এমন ৮ জনকে চিহ্নিত করে পুলিশ। তবে গ্রেফতারের পরপরই তাদের মোবাইলে প্রাপ্ত ছবি ও জিজ্ঞাসাবাদে দেওয়া বয়ানে মিলেছে চাঞ্চল্যকর কিছু তথ্য। আর তাতেই নড়েচড়ে বসেছে ফতুল্লা থানা পুলিশ। এরপর বিভিন্ন এলাকা থেকে ছয়জনকে গ্রেফতার করে ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ।

গ্রেফতাররা হচ্ছেন-রাসেল (১৯), আব্দুল হাকিম (১৯), সৌরভ ওরফে হৃদয় (১৮), আনিস (১৮), আব্দুস ছালাম স্বাধীন (১৯) ও আশিক (১৮)। তারা সবাই আমানের ঘনিষ্ট বন্ধু ও একসঙ্গে চলাচল করতেন বলে জানিয়েছে নিহত কিশোরের পরিবার।

গ্রেফতারদের একজন জানান, ‘আমানসহ ৯ বন্ধু মিলে আমরা নিয়মিত একসঙ্গে আড্ডা দিতাম। সেখান থেকেই স্বপ্ন জাগে একদিন ফতুল্লার শিল্পাঞ্চলের ডন তথা প্রভাব বিস্তারকারী হবে। কে কত দ্রুতগতিতে অস্ত্র চালাতে পারবে তা ইংরেজি সিনেমার অ্যাকশন দেখে আমরা অনুপ্রাণিত হতাম। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্ধুদের কেউ কেউ প্রস্তাব দেয় রাজনৈতিক নেতার হাত ধরার। আবার কেউ প্রস্তাব দেয় নিজেরাই গ্রুপ তৈরি করে বিসিক নিয়ন্ত্রণ করবো। এরপর থেকে নিজেদের প্রস্তুত করতে জন্য প্রতি মাসে প্রাপ্ত বেতনের টাকায় ছুরি, চাকু কিনে তা সংগ্রহ করা শুরু হয়।’

মামলা সূত্রে জানা যায়, তাদের মোবাইলে দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে মারমুখী ভঙ্গিমায় তোলা ছবি পাওয়া গেছে। তারা যে টাকা বেতন পেতো তা দিয়ে প্রতি মাসেই ব্যক্তিগতভাবে ছুরি, চাকু কিনে সংগ্রহ করতো। এসব ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে প্রভাব বিস্তারের পরিকল্পনা ছিল তাদের। প্রতি শুক্রবার নিহত আমানসহ বাকি সঙ্গীরা পাকাপুল এলাকার একটি মাঠে জড়ো হয়ে পরিত্যক্ত বাড়ির পাশে গিয়ে ছবি তুলে রাখতো। এছাড়া বিভিন্ন সময় মারামারি ও প্রভাব বিস্তারের চেষ্টাও করতো তারা।

২০২০ সালের ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে এইচআর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভেতর এক তরুণীকে গণধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ভুক্তভোগী তরুণী টঙ্গী আবদুল্লাহপুর এলাকার বাসিন্দা।

মামলার বরাত দিয়ে পুলিশ জানায়, টিকটকে অভিনয় করার জন্য ওই তরুণীর (১৮) সঙ্গে চুক্তি করেন নারায়ণগঞ্জ শহরের চাষাঢ়া এলাকার সালাম নামের এক ব্যক্তি। সালামের দেওয়া একটি নম্বরে যোগাযোগ করে ওই তরুণী রূপগঞ্জ উপজেলার ব্রাক্ষ্মণখালী এলাকায় আসেন। সেখানে তাকে এইচআর মডেল স্কুলের ভেতর আসতে বলা হয়। রাত ৮টার দিকে তাকে স্কুলে গেলে তাকে রিসিভ করেন এইচআর মডেল স্কুলের কেয়ারটেকার জামাল হোসেন। তরুণী স্কুলে উপস্থিত হয়ে বুঝতে পারেন এখানে কোনো শুটিং হবে না। বিপদ আঁচ করতে পেরে বেরিয়ে যেতে চাইলে তার মুখ বেঁধে ফেলা হয়। পরে রাত ১০টা ৩টা পর্যন্ত তাকে দলবদ্ধ ধর্ষণ করেন আসামিরা।

অরাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন আমরা নারায়ণগঞ্জবাসী’র সভাপতি বীরমুক্তিযোদ্ধা নুর উদ্দিন আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, ‘টিকটকে বিশেষ করে উঠতি বয়সের ছেলেগুলো বেশি আসক্ত হয়ে পড়ছে। একটি চক্র বেতনের টাকা দিয়ে অস্ত্র কিনে মহড়া দেয়। উঠতি বয়সের মেয়েরাও এখানে জড়িয়ে যাচ্ছে। অনেকে অনৈতিক কাজে জড়িয়ে পড়ছে। এগুলোর লাগাম টেনে ধরা দরকার।’

তিনি বলেন, শেষ পর্যন্ত এগুলোর পরিণতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক হয়। সন্তানদের বখে যাওয়া ঠেকাতে অভিভাবকদের সচেতন হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

নারায়ণগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জায়েদুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, টিকটক সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হচ্ছে। এটা দমনের জন্য সামাজিকভাবে সবাই মিলে কাজ করতে হবে। যারা এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত তাদের বাবা-মাসহ অভিভাবকদের আরও সচেতন হতে হবে। সেই সঙ্গে সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে যারা সম্পৃক্ত তাদেরও সচেতন হতে হবে। অন্যথায় টিকটক মহামারি আকার ধারণ করবে।

তিনি আরও বলেন, ‘পুলিশের নজরদারি রয়েছে। যেখানেই এসব (টিকটকারদের অপরাধে জড়িয়ে পড়া) ঘটনা ঘটছে সেখানেই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *