টাকা চেয়ে না দিলেই গুঁড়িয়ে দিতেন বাড়ি

বাংলাদেশ

নিউজ ডেষ্ক- সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ হত্যা মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্তকৃত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ এখন কনডেমড সেলে। কক্সবাজার দায়রা জজ আদালতে গত সোমবার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরই অনেকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন তার ‘দুঃশাসন’-এর সময়ে বিনাদোষে ক্ষতিগ্রস্তরা। নিজেদের ক্ষতি হয়তো কোনো দিন পুষিয়ে উঠবে না। এর পরও একজন খারাপ পুলিশ কর্মকর্তার অপকর্মের লাগাম টেনে শাস্তি নিশ্চিত হওয়ায় যত প্রশান্তি।

টেকনাফের সাধারণ মানুষের অভিযোগ, মাদক নির্মূলের নামে সাধারণ মানুষকে বন্দুকযুদ্ধের দোহাই দিয়ে কেবল হত্যায় মেতে ছিলেন না ওসি প্রদীপ; কারও বাড়িতে অভিযানে গেলে বাড়ির স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুট, বাড়ির সুন্দরী নারীদের থানায় এনে জোরপূর্বক সম্ভ্রমহানিও ছিল ওসি প্রদীপের রুটিন কাজ।

এর বাইরেও কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে চাহিদামাফিক টাকা না পেলে প্রতিশোধ নিতেন একটু ভিন্নভাবে। ওইসব ব্যক্তির ঘরবাড়ি বুলডোজারে গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রচার চালাতেন- মাদককারবারিদের বাড়িতে গায়েবি হামলা বলে। কিন্তু সব জানার পরও ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে মুখ খোলার সাহস ছিল না কারোরই। কেউ বিরুদ্ধে দাঁড়ালেই হুমকি দিতেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের গায়েবি হামলা হতে পারে তার বাড়িতেও।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ওসি প্রদীপ ব্যবসায়ী ও সচ্ছল ব্যক্তিদের টার্গেট করে মোটা অঙ্কের টাকা ডিমান্ড করতেন। তার জন্য ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে দাঁড় করাতেন মাদক কারবার কিংবা অবৈধ কারবারে জড়িত থাকার মিথ্যা অভিযোগ। তা থেকে মুক্তির জন্য কাউকে এক কোটি, কারও কাছে ৫০ কিংবা ২০ লাখ টাকা চাওয়া হতো। নির্দিষ্ট সময়ে ওসি বরাবর সেই টাকা পৌঁছতে ব্যর্থ হলেই রাতে শুরু হতো ওইসব ব্যক্তির ঘরবাড়ি ভাঙার কাজ। বুলডোজারে সব কিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে সকালে ওসি প্রচার করতেন- ‘ইয়াবাকারবারিদের বাড়িতে গায়েবি হামলা!’ আবার কারও কারও বাড়িঘর ইয়াবা কারবারের টাকায় নির্মিত, এমন মিথ্যা অজুহাতেও ভেঙে দিয়েছেন। তাদের মধ্যে টেকনাফ সদর ইউনিয়নের শিলবনিয়াপাড়ার ডা. হাজি মোহাম্মদ হানিফের বাড়ি, নাজিরপাড়ার মো. ইসলামের বাড়ি, সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান জাফর আহমদের বাড়ি, মৌলভীপাড়ার হাজি ফজল আহমদের বাড়ি অন্যতম। অথচ তাদের বাড়িগুলো টেকনাফ সীমান্তে ইয়াবা কারবার শুরুর অনেক আগেই তৈরি। মূলত প্রবাসে থাকা পরিবারের সদস্যদের পাঠানো টাকায় তারা বাড়ি করেছিলেন বলে স্থানীয়রা জানান।

শিলবনিয়াপাড়ার ডা. হানিফের স্ত্রী শামীম আরা বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে ছিলেন। তার রোজগারের টাকা দিয়েই আমাদের বাড়িটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তখন ইয়াবার কোনো নামগন্ধও ছিল না। অথচ টেকনাফ থানার সাবেক ওসি প্রদীপ কুমার দাশ একরাতে বাড়ির প্রধান গেট ভেঙে দলবল নিয়ে অতর্কিতে ঢুকে পড়েন এবং সন্ত্রাসী স্টাইলে ভাঙচুর চালান। প্রথমে বাড়ির আসবাবপত্র ভাঙচুর, পরে বুলডোজার দিয়ে সীমানাপ্রাচীর ভেঙে দেন। এ ছাড়া ভেতরের অংশ বড় হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে দেন।’

তিনি অভিযোগ করেন, ‘বাড়ি ভাঙার আগে ওসি প্রদীপ আমাদের কাছ থেকে এক কোটি টাকা দাবি করেছিল। আমরা সেই টাকা কীভাবে ব্যবস্থা করব- এমন প্রশ্ন করতেই উল্টো আমাদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। বারবার বিভিন্ন মাধ্যমে দ্রুত সময়ে টাকা পৌঁছে দেওয়ার হুমকি দিতেন। শেষমেষ আমার পরিবার টাকা দিতে ব্যর্থ হওয়ায় এসে বাড়িঘর ভাঙচুর করেন, বিভিন্ন আসবাবপত্র লুট করে নিয়ে যান এবং আমার দুই নিরপরাধ ছেলেকেও তুলে নিয়ে মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে পাঠান।’

নাজিরপাড়ার মোহাম্মদ ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার টাকা দিয়ে আমার নিজের বসতভিটায় একটি দোতলা বাড়ি করেছিলাম। কিন্তু আমার হালাল উপার্জনে তৈরি বাড়িটি নাকি ইয়াবা কারবারের টাকায় নির্মিত, এমন অভিযোগ তুলে ওসি প্রদীপ একদিন এসে বাড়ির বেশিরভাগ অংশই বুলডোজার দিয়ে ভেঙে দেন। তখন ওসি প্রদীপের বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে সাহস পেত না বলে আমাদের আকুতিমিনতি কেউ-ই শুনেনি।’

টেকনাফের স্থানীয় বাসিন্দা রহমত উল্লাহ বলেন, ‘কারও সুন্দর বাড়ি দেখলেই যেন সেটি ভাঙার নেশা ছিল ওসি প্রদীপের। ইয়াবাকারাবারিদের বেশ কয়েকটি বাড়ি তিনি ভেঙেছেন সত্য, কিন্তু তারচেয়ে বেশি ভেঙেছেন প্রবাসীদের কিংবা বৈধ ব্যবসায় উপার্জিত টাকায় নির্মিত বাড়িঘর।’

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *