চোখ জুড়ানো সৌন্দর্য উটি’র

ফিচার breaking subled

নিউজ ডেষ্ক- কথায় আছে, পুরো ভারত দেখা মানে-পৃথিবীর রূপ-সৌন্দর্য দেখা। কোথাও প্রচণ্ড গরম, কোথায় প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কোথাও পাহাড়, কোথাও বরফ। নানা রঙের প্রাকৃতিক সমাহারের সঙ্গে নানা ভাষাও সমানতালে চলছে। ভারতে হাজারও প্রাকৃতিক সৃষ্টির মধ্যে তামিলনাড়ুর নীলগিরি উটি পাহাড়টিও অনন্যা।

যে পাহাড়, পাহাড়ে তলদেশ নিয়ে ইতিহাস রয়েছে। সমতট থেকে পাহাড়ের উঁচুতে পৌঁছতে প্রায় ৭০ কিলোমিটার রাস্তা পাড়ি দিতে হয়। হাজার হাজার আঁকাবাঁকা পথ পাড়ি দিয়ে চূড়ায় উঠতে হয়। মেঘ এসে ধাক্কা দেয় শরীরে। দিল্লিতে এখন তাপমাত্র ৪০ থেকে ৪৪, আর উটিতে ৭ থেকে ৯ ডিগ্রি। শীতে শূন্যে নেমে আসে। এ পাহাড় ঘিরেই গড়ে উঠেছে বসতি, যুগের পর যুগ।

সৃষ্টির অপরূপ ঘেরা উটির গায়ে এখনও লেগে আছে ব্রিটিশ উপনিবেশের গন্ধ। তলিয়ে দেখলে দেখা মেলে সেখানকার ভূমিপুত্রদেরও। টোডা, কোটার মতো সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখনো নিজেদের সংস্কৃতি, ভাষা, পোশাককে আঁকড়ে থেকেও আদ্যন্ত আধুনিক।

উটি পাহাড় ঘিরে বোটানিক্যাল গার্ডেন, উটি লেক, জন সালিভানের স্টোন হাউসের বাইরেও অসংখ্যন সৌন্দর্য প্রাকৃতিক দৃশ্যক রয়েছে। হাতি থেকে বানর, হাজার রকমের পাখিও এ পাহাড় ঘিরে বেঁচে আছে।

নয়াদিল্লি থেকে তামিলনাড়ু কোয়েম্বত্তুর বিমান রানওয়েতে চাকা ছোঁয়ার পরই চোখে ভেসে আসলে পাহাড় আর সবুজ ঘেরা সারি সারি নারকেল গাছ, সঙ্গে হাজারও প্রজাতির গাছগাচালি।

কোয়েম্বত্তুর বিমানবন্দর থেকে পুলিশি নিরাপত্তায় সোজা ছুটছিলাম তামিলনাড়ু নীলগিরি জেলার উটি পাহাড়ের পানে। রাস্তা ধরে ছুটতেই হঠাৎ বৃষ্টি হঠাৎ রোদ যেন আমাকে রাঙিয়ে তুলছিল।

রাস্তার দু’ধারে প্রথম প্রথম শুধুই নারকেল আর কলাবনের সারি চোখে পড়ে। কারিপাতা বোঝাই ট্রাক দেখেই মনে হল, আগামী ক’টা দিন পাতে এই জিনিসটি তো থাকবেই! খানিক পরেই পাকদণ্ডী বেয়ে ঘুরে ঘুরে গাড়ি ভাঙতে লাগল চড়াই। পাহাড়ের তলদেশ থেকে পাহাড়ে উঠাৎ শুরুতে রাস্তার দুপাশে থাকা একটি লালচে ল্যা ম্প পোস্টে হর্ণ বেজে উঠলো। সংশ্লিষ্টরা জানালেন, এটি বিশেষ সংকেত, পাহাড়ে উঠা হচ্ছে এমনটা জানান দেওয়া।

এক একটা পাহাড়ের বাঁক ঘুরছে আর যেন সরে যাচ্ছে এক একটা পর্দা। উচ্চতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাল্টে গেল আশপাশের সবুজও। এক পর্যায়ে সবুজের বুকে মেঘ ঢেকে যাচ্ছিল বার বার। পাহাড় দেখা যাচ্ছি না। পাইন, ইউক্যালিপ্টাস, ওয়াটলের গহিন সমারোহের মাঝে পেরিয়ে যেতে লাগলাম একের পর এক এলিফ্যান্ট করিডোর, খাদের গার্ড ওয়ালে বসে কিচিরমিচির করা বাঁদরের দল। হঠাৎ ‘ভ্যাঁপোর’ হর্ন শুনে চমকে দেখি অন্ধকার! তখন বিকাল ৪টা। অন্ধকার বেয়েই গাড়ি ছুটছে আরও উঁচুতে, আঁকাবাঁকা পথ বেয়ে। অবিশ্বাস্য সাবলীলতায় সাধারণ যানগুলো ভয়ঙ্কর টার্ন পেরোচ্ছে সারি সারি। বুঝলাম, উটি শহরের কাছাকাছি এসে পড়েছি। পাহাড়ের উঁচুতে বসবাস রয়েছে বাসিন্দাদের।

স্টার্লিং ফার্ন হিল হোটেলে উঠবো আমি। সন্ধ্যা না হতেই অন্ধকার, শীত যেন বাড়ছে। কিছুটা অক্সিজেন নিতে সমস্যা হচ্ছিল। আমি জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছিলাম। একপর্যায়ে পৌঁছলাম হোটেলে। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকতেই চোখ আটকাবে দেওয়ালজোড়া কারুকাজে। ততক্ষণে এক কিশোরী আমাকে স্বাগতম জানালেন। কপালে চন্দনের টিপ দিয়ে, আগুনের শিখার বাতাসে ভালোবাসা জানালেন। এদের সংস্কৃতি অনুযায়ী আমাকে বরণ করলেন।

১৯৮৩-৮৪ সালের উটিকে ফ্রেমে ধরেছিল ডেভিড লিনের ‘আ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া’, কমল হাসন-শ্রীদেবীর ‘সদমা’। কসমো-কালচারে সমৃদ্ধ এ শহরকে ব্রিটিশরা হ্যান্ডমেড চকলেট তৈরি থেকে শুরু করে শিখিয়েছিল অনেক কিছুই। হাতে তৈরি চকলেটের স্বাদ অসাধারণ। কিনে খেলাম, স্বাদ লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। তবে এটা বলতে পারি নারিকেলের দুধ আর বিভিন্ন বাদাম মিশ্রিত এ চকলেট একবার খেলে বারবার খেতে ইচ্ছে করবে।

তামিলনাড়ুর নীলগিরি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত উটি ব্রিটিশ আমল থেকেই দক্ষিণাত্যের অন্যতম জনপ্রিয় একটি শৈলশহর। উটির আসল নাম উধাগমণ্ডলম। পাইনের বন, চা-কফির বাগান আর মেঘে ঘেরা উটিতে রয়েছে একাধিক লেক, জলপ্রপাত ও বোটানিক্যাল গার্ডেন।

‘উদাগামণ্ডলম’ আদি নাম হলেও লোকের মুখে পরিচিত ‘উটি’ হিসেবেই। টোডা জনজাতি অধ্যুষিত এই জায়গা যেন আপনাকে মনে করিয়ে দেবে শাহরুখ খানের সেই টয়ট্রেনের উপরে উঠে ‘ছাইয়া ছাইয়া’ নাচের গানের দৃশ্য।

কোথায় কোথায় ঘুরবেন:
১. উটি লেক – উটি সফরের এক অসাধারণ অংশ হিসেবে আপনি উটি হ্রদকে বাদ দিতে পারবেন না। এই হ্রদটি বোটিংয়ের জন্যে বেশ বিখ্যাত।

২. এমারেল্ড হ্রদ – উটি থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরত্বে এই হ্রদটি অবস্থিত। সাইলেন্ট ভ্যালিতে রয়েছে এই হ্রদটি। এটি বনভোজনের এক আদর্শ জায়গা।

৩. বোট্যানিক্যাল গার্ডেন – ৫৫ একরের বেশি জায়গাজুড়ে এই বোট্যানিক্যাল গার্ডেন উটির অন্যতম আকর্ষণ। এখানে প্রায় ২০ মিলিয়ন বছর আগেকার একটি গাছের কাণ্ডের জীবাশ্ম রয়েছে।

৪. দোদাবেতা চূড়া – উটিতে গিয়ে ২৬২৩ মিটার উঁচু এই পাহাড়শীর্ষ না দেখলেই নয়। এ ছাড়াও উটিতে কালহাট্টি জলপ্রপাত, মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান, নিডল রক ভিউ পয়েন্ট ইত্যাদিও আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে।

কীভাবে যাবেন:
রেলপথ দিয়ে শুরু করি। কলকাতা থেকে কোনো সরাসরি ট্রেন নেই উটি যাওয়ার জন্য। আপনাকে ভেঙে ভেঙেই যাতায়াত করতে হবে। প্রথমে কোনো ট্রেন যা চেন্নাই যায়, তাতে উঠে পড়তে হবে। সেখানে যেতে প্রায় ৩০ ঘণ্টার মতো সময় লাগবে আপনার। এক দিন চাইলে চেন্নাই ঘুরেও নিতে পারেন। সেখান থেকে মেট্টুপালায়াম স্টেশন। প্রায় ১০ ঘণ্টার পথ। সেখান থেকে ট্রেনে করে কুন্নুর, প্রায় ২ ঘণ্টা। চাইলে আপনি গাড়ি ভাড়াও করতে পারেন। সবচেয়ে ভালো হয় মেট্টুপালায়াম থেকে টয়ট্রেনে চেপে যাওয়া। সরাসরি উটি স্টেশন। এছাড়াও আপনি প্লেনে করে চলে যেতে পারেন চেন্নাই অথবা কোয়েম্বাতুর। সেখান থেকে একইভাবে উটি যাত্রা।

কোথায় থাকবেন:
পর্যটন স্থান হওয়ায় উটিতে থাকার জায়গার অভাব নেই। আগে থেকেই আপনি মোবাইল অ্যাপেও বুক করে রাখতে পারেন আপনার পছন্দসই হোটেল ও ঘর।

তবে মনে রাখবেন শীত কিংবা গরম, শীতের জামা-কাপড় নিতে যেন ভুলবেন না। ওটা নিতে মিস করলে, আপনাকে কাবু করবে পাহাড়ের শীত, মেঘ।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *