প্রভুভক্ত হিসেবে সবচেয়ে বেশি নজির সৃষ্টি করা প্রাণী হচ্ছে কুকুর। মহান আল্লাহ পাকের তৈরি এই পৃথিবীতে মানুষের পরই প্রাণিজগতের স্থান। বিবেক, বোধশক্তি ও জ্ঞান অর্জনের যোগ্যতা এবং সত্য-মিথ্যা ও ভালো-মন্দ পরখ করার ক্ষমতা— ইত্যাদির কারণে মানুষ অন্যান্য প্রাণী থেকে আলাদা ও বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। এসব গুণের কারণেই মানুষ শ্রেষ্ঠ জীবের মর্যাদা পেয়েছে।
প্রাণীজগতকে পৃথক জাতিসত্তার স্বীকৃতি দিয়ে কোরআনে বলেন, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো একেক জাতি।’ (সুরা আনআম, আয়াত : ৩৮)
প্রাণীজগতের অন্যান্য সদস্যের মতো কুকুরও আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি। কুকুর সম্পর্কে ইসলামের বিভিন্ন নির্দেশনা পাঠকদের জানার সুবিধার্থে সংক্ষিপ্তাকারে উল্লেখ করা হলো।
যেসব কারণে কুকুর পালন বৈধ
শিকারের উদ্দেশ্যে, ফসল হেফাজতের উদ্দেশ্যে, পাহারাদারির জন্য, ছাগল-ভেড়া ইত্যাদির হেফাজতের লক্ষ্যে, ঘরবাড়ি, দোকান ও অফিস পাহারার জন্য, অপরাধের উৎস সন্ধান ও অপরাধীকে চিহ্নিত করার উদ্দেশ্যে কুকুর লালন-পালন করা বৈধ। (ফতোয়াতে মাহমুদিয়া : খ. ১৮, পৃ. ২৬৪/ ফতোয়ায়ে আলমগিরি : খ. ৪, পৃ. ২৪২)
কুকুর পালন কখন অবৈধ
শখ করে ঘরে কুকুর রাখা, মানুষের চেয়ে কুকুরের যত্ন বেশি নেয়া, কুকুরের সঙ্গে মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন করা ইসলামে নিষিদ্ধ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি শিকার করা বা গবাদি পশু পাহারা অথবা শস্যক্ষেত পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্য ছাড়া— কুকুর লালন-পালন করে, প্রতিদিন ওই ব্যক্তির দুই কিরাত পরিমাণ নেকি কমে যায়।’ (মুসলিম, হাদিস : ১৫৭৫; তিরমিজি, হাদিস : ১৪৮৭)
অন্য হাদিসে আছে, ‘এক কিরাত হলো, উহুদ পাহাড় সমপরিমাণ।’ (মুসনাদে আহমদ, হাদিস নং : ৪৬৫০)
কুকুরের শরীর ও কিছু হুকুম
আমাদের হানাফি মাজহাব মতে, কুকুরের শরীর নাপাক নয়। তাই কুকুর কারো শরীর বা কাপড় স্পর্শ করলে তা নাপাক হবে না। তবে কুকুরের লালা নাপাক। কুকুর মুখ দিয়ে কারো জামা টেনে ধরলে যদি কাপড়ে লালা লেগে যায়, তবে কাপড় নাপাক হয়ে যাবে; অন্যথায় নাপাক হবে না। (আল-বাহরুর রায়েক : ১/১০১; ফতোয়াতে হিন্দিয়া : ১/৪৮; আদ্দুররুল মুখতার : ১/২০৮)
তবে কুকুরের গোশত খাওয়া সম্পূর্ণভাবে হারাম। এমনকি আসমানি সব ধর্ম মতেও জায়েজ নেই।
কুকুর হত্যার হুকুম
শিকারির জন্য রাখা কুকুর ও পাহারার জন্য রাখা কুকুর মেরে ফেলা— সর্বসম্মতিক্রমে জায়েজ নেই। তবে পাগলা কুকুর ও কষ্টদায়ক কুকুর মেরে ফেলা— সব আলেমের মতে বৈধ। সাধারণ অবস্থায় থাকা কুকুর নিধন করা কিংবা মেরে ফেলা ইসলামের দৃষ্টিতে অপছন্দনীয়। (কুয়েতভিত্তিক ইসলামী বিশ্বকোষ ‘আল-মওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল-কুয়েতিয়্যা, খণ্ড : ৩৫, পৃষ্ঠা : ১৩২-১৩৩)
কুকুরকে খাদ্য-পানি দেওয়ার হুকুম
সম্ভব হলে কুকুরকে খাবার দেওয়া, পানি দেওয়া, কুকুর কোথাও পড়ে গেলে তাকে উদ্ধার করা ইসলামের দৃষ্টিতে সওয়াবের কাজ। কুকুরকে পানি পান করানোর কারণে ব্যভিচারী নারীকেও জান্নাত দেওয়া হয়েছে বলে হাদিসে এসেছে।
রাসূল (সা.) বলেন, ‘একবার এক পিপাসাকাতর কুকুর কূপের পাশে ঘোরাঘুরি করছিল। পিপাসায় তার প্রাণ বের হওয়ার উপক্রম হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বনি ইসরাইলের এক ব্যভিচারী নারী তা দেখতে পায়। সে নিজের পায়ের মোজা খুলে কুকুরটিকে পানি পান করায়। এ কারণে তার অতীত পাপ ক্ষমা করে দেওয়া হয়।’ (বুখারি, হাদিস : ৩৪৬৭)
যে কারণে ঘরে কুকুর রাখা নিষিদ্ধ
কুকুরের ব্যাপারে ইসলামের কঠোর নির্দেশ কেবল এটাই যে শখ করে ঘরে কুকুর রাখা নিষেধ। হাদিস শরিফে আছে, ‘যে ঘরে কুকুর আছে, সে ঘরে রহমতের ফেরেশতারা প্রবেশ করেন না।’ (বুখারি, হাদিস : ৫৫২৫)
আর কুকুরের লালা যেহেতু নাপাক, তাই কোনো পাত্রে কুকুর মুখ দিলে তা তিন বা সাতবার ধৌত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এ নির্দেশের পেছনে কয়েকটি যুক্তি আছে-
প্রথমত : কুকুরের মধ্যে শয়তানের প্রভাব বেশি। তাই আজানের সময় কুকুর আওয়াজ করে।
দ্বিতীয়ত : কুকুর মনিবভক্ত হলেও তার মধ্যে খারাপ স্বভাব বেশি। যেমন—অন্যকে সহ্য না করা, সব সময় দৌঁড়-ঝাঁপে লিপ্ত থাকা, পচা ও নিকৃষ্ট খাবার খাওয়া, যেখানে-সেখানে অশ্লীল কাজে লিপ্ত থাকা, মানুষকে কষ্ট দেওয়া, খাবার দেখলে লালায়িত হওয়া ইত্যাদি। ‘সঙ্গীর প্রভাবে মানুষ প্রভাবান্বিত হয়’—এর আলোকে কুকুরের সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে।
তৃতীয়ত : কুকুর যেন মানুষের ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য কুকুরের সঙ্গ থেকে দূরে থাকতে বলা হয়েছে। কেননা কুকুরের নখ ও মুখে বিষাক্ত জীবাণু রয়েছে। কুকুরের ওপর আস্থা রাখা যায় না। যেকোনো সময় সে মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এতে জলাতঙ্কসহ নানা রোগ হতে পারে।
চতুর্থত : আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান প্রমাণ করেছে, নিজ ঘরে, বিছানায় কুকুর রাখলে অ্যালার্জি, ভাইরাস সংক্রমণসহ বিভিন্ন বিপত্তি ঘটতে পারে।
কুকুরের যেসব কিছু মানুষের জন্য ক্ষতিকর
এ বিষয়ে আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ড. ইউসুফ আল-কারাজাভি ‘আল-হালালু ওয়াল হারামু ফিল ইসলাম’ শীর্ষক বইয়ে কুকুর নিয়ে জার্মান ও লন্ডনের বিভিন্ন গবেষকের উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। তারা কুকুরের সঙ্গ মানুষের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর বলে অভিমত দিয়েছেন।
তিনি লিখেছেন, ‘স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে বিচার করলে কুকুর পালা ও তার সঙ্গে হাস্যরসিকতায় যে বিপদ মানুষের স্বাস্থ্য ও জীবনের ওপর ঘনীভূত হয়ে আসতে পারে, তাকে সামান্য ও নগণ্য মনে করা কিছুতেই উচিত নয়। অনেক লোক নিজের অজ্ঞতার কারণে ভারি মাসুল দিতে বাধ্য হয়। তার কারণ এই যে কুকুরের দেহে এমন এমন জীবাণু রয়েছে, যা এমন রোগ সৃষ্টি করতে পারে, যা স্থায়ী এবং যা চিকিৎসা করে সারানো যায় না। কত লোক যে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে জীবন দিতে বাধ্য হয় তা গুনে শেষ করা যায় না। এসব জীবাণু মানুষের কলিজায় প্রবেশ করে। আর সেখানে নানাভাবে আত্মপ্রকাশ করে। তা অনেক সময় ফুসফুসে, ডিম্ব, তিল্লি, গুর্দা ও মস্তকের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন এগুলোর আকৃতি অনেকটা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এমন অবস্থা দেখা দেয় যে বিশেষজ্ঞরাও তা ধরতে ও চিনতে অক্ষম হয়ে পড়েন।
যা-ই হোক, এ জীবাণুর দরুন যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তা দেহের যে অংশেই হোক না কেন, স্বাস্থ্যের পক্ষে খুবই ক্ষতিকর ও মারাত্মক। এসব জীবাণুর কোনো চিকিৎসা আজ পর্যন্ত জানা যায়নি। এ করণে চিকিৎসা-অযোগ্য রোগের মোকাবিলা করার জন্য আমাদের পূর্ণশক্তিতে চেষ্টা করতে হবে। এ বিপদ থেকে মানুষকে বাঁচাতে হবে। ’
জার্মান চিকিৎসাবিদ নুললর বলেছেন, ‘কুকুরের জীবাণুর দরুন মানবদেহে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়, তার সংখ্যা শতকরা ১-এর কম নয় কিছুতেই। আর কোনো কোনো দেশে শতকরা ১২ পর্যন্ত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকে। এ রোগ প্রতিরোধের সর্বোত্তম পন্থা হচ্ছে, এর জীবাণুগুলোকে কুকুরের দেহ পর্যন্তই সীমাবদ্ধ করে রাখা, তাকে ছড়িয়ে পড়তে না দেওয়া।
ইসলামী নিয়মনীতি অবলম্বন করে আল্লাহ তায়ালা আমাদের পশু-পাখি লালনের তাওফিক দান করুন। আমিন।