খামারিরা জিতেও হেরে গেলো

বাংলাদেশ

নিউজ ডেষ্ক- পবিত্র ইদুল আজহার ঈদ আগামী ১০ জুলাই। ঈদকে কেন্দ্র করে জমে উঠেছে রাজশাহীর সিটি পশুর হাট। আজ রোববার হাটে দেখা গেছে হাজার হাজার গরু-মহিষের আমদানি। বেচা-কেনাও চোখে পড়ার মতো। দামও বেশ ভালো। তবে, ভালো দাম পেয়েও গবাদিপশুর খাদ্যের দাম বাড়ার কারণে লাভের ভাগ কমে গিয়েছে। ফলে জিতে গিয়েও হেরে গেলেন খামারিরা। নিট মুনাফা ঘরে তুলতে পারলেন না তারা। এমনই দাবি খামারিদের।

খামারি ও কৃষকরা বলছেন, গতবছরের তুলনায় ভালো দামে গরু বিক্রি করছেন তারা। প্রতি বড় গরুতে পাঁচ থেকে দশ হাজার টাকা লাভ হয়েছে। খৈল, ভুষি, ভুট্টার আটা, সয়াবিন মিলসহ দানাদার খাদ্যের অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে লাভের টাকা ঘরে যাচ্ছে না। অনেকে গরু বেচাকে “লোহা লবন সমান সমান” হিসেবেও দেখছেন।

আজ রোববার (৩ জুলাই) সাপ্তাহিক হাটে দেখা গেছে গরু, মহিষের সরবরাহ বেশ ভালো। দূর-দূরান্তের পাইকাররাও এসেছেন। দামাদামি করছেন; কিনছেন কেউ কেউ। মাঝারি ও কোরবানিযোগ্য ছোট গরুর আমদানি সর্বোচ্চ। এসব গরুর চাহিদা থাকায় অপেক্ষাকৃত বেশি বিক্রি হয়েছে। আমদানি বেশি হওয়ায় দাম কম ঠিক এমনটি নয় বরং বিপুল উৎসাহে কেনা-বেচা চলছে। অন্যদিকে বড় গরুর বেচা-কেনা কম হতে দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাটে পশুর সরবরাহ ছিল চোখে পড়ার মত। বিক্রেতারা পশু নিয়ে অপেক্ষা রোদের মধ্যে। অনেকে দাঁড়িয়ে বচসা করছেন নতুন ক্রেতার সাথে। হাটে আনুমানিক ১১ থেকে ১২ মণ ওজনের ষাঁড় গরু ২ লাখ ৭০ থেকে তিন লাখের কাছাকাছি টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে তিন থেকে সাড়ে ৪ মণ ওজনের গরু। ৫ মণ ওজনের গরু বিক্রি হয়েছে ১ লাখ ১৫ থেকে এক লাখ বিশ হাজার টাকা পর্যন্ত। এছাড়া সাড়ে তিন মণ ওজনের গরুর দাম হাঁকা হয়েছে ৮৫ হাজার টাকা।

গরু ব্যবসায়ী উসমান আলী এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, তিনি জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে বাড়ি বাড়ি গরু কিনে হাটে এসে বিক্রি করেন। গতবারে যেসব গরু ১ লাখ ২০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছেন সেসব গরু এবার ১ লাখ ২৫ হাজার বলছেন ক্রেতারা। ঈদের এই সময় হাট জমজমাট থাকে। এবার আমদানি বেশি, বেচা-বিক্রিও বেশি। এবার গরুর সরবরাহ ভালো ক্রেতারা আসছে। আর হাটে বড় গরুর চাহিদা খুবই কম। কুরবানির জন্য সাড়ে ৩ মণ কিংবা ৪ মণ ওজনের গরু বেশি বিক্রি হচ্ছে।

তিনি আরো জানান, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেটের বড় বড় ব্যবসায়ীরা হাটে আসেন। এবারও এসেছেন অনেকে। তবে, সিলেটে বন্যার কারণে সেখানকার পাইকার আসেনি বললেই চলে। এই হাট থেকে পশু কিনে দেশের বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন।

চট্টগ্রাম থেকে গরু কিনতে এসেছেন এস এম আল মামুন। তিনি এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, ঈদের এক সপ্তাহ আগেই তারা কোরবানির পশু কিনে থাকেন। প্রতিবছর ৫০ থেকে ৮০ লাখ টাকার গরু কিনেন। হাট ঘুরে দেখে সব জিনিসের সাথে তুলনায় গরুর দাম খুব একটা চড়া হয়নি। এবার দাম সহনীয় থাকায় আরো বেশি কিনবেন। এবারও এক সপ্তাহের আগেই এসেছেন। হাটে পছন্দসই ভালো পশু আছে। দুপুর পর্যন্ত কিনেছেন ৫টি।

ঢাকার ব্যবসায়ী আবু সুফিয়ান এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, এখনো হাটের পরিস্থিতি তেমন বোঝা যাচ্ছে না। এসময় বেচাকেনার জন্য বেশ জমজমাট হয়ে থাকে। হাটে প্রচুর গরু এসেছে। শেষ পর্যন্ত গরু কিনেই ফিরব।

ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, গতবারের চেয়ে এইবার গরু প্রতি ৫ থেকে দশ হাজার দাম বেশি। গরুর উৎপাদন খরচ বাড়লেও সেভাবে বাড়েনি গরুর দাম এমনই বলছেন বিক্রেতারা। তারা বলছেন, গরুর খাদ্য কিনতে হচ্ছে বেশি দাম দিয়ে। ৬’শ টাকা ভুট্টা ১২’শ টাকা। ২৫’শ টাকার খৈলের বস্তা এখন ৩৩’শ টাকা দাম। খড়ের দাম বেড়েছে। এমন কোন খাবার নাই যে খাবারের দাম বাড়েনি। লাভ যদি দেখা যায় তা প্রকৃত লাভ নয়। খরচের তুলনায় এর দ্বিগুণ লাভ করলে ভালো হতো।

এ বিষয়ে একমত প্রকাশ করেছেন ক্রেতারাও। তারা বলছেন, খামারিরা খুববেশি লাভ করতে পারবে না। কারণ বাজারে মাংসের কেজি ৬৫০ টাকা হলেও হাটে সাড়ে ৫’শ করে দাম ধরে গরু বেচা-কেনা হচ্ছে। ১৮ হাজার টাকা মণ হিসেবেও গরু বিক্রি হয়েছে। তবে, এ হাটে ২০ হাজারের কম বিক্রি হয়নি। ২৫ হাজার টাকা মণ হিসেবে দাম ধরা হয়েছে। এখন এ দামে খামারিদের লোকসান না হলেও লাভ হবেনা।

অন্যদিকে হাটে অনাকাঙ্খিত ঘটনা এড়াতে বসেছে ভেটেরিনারি টিম। পবা উপজেলার প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কর্মকর্তা ডাঃ মোঃ মনিরুল ইসলাম জানান, গরুর কোনো অসুখ বিসুখ হলে তারা প্রাথমিক চিকিৎসা দিচ্ছেন। এখন পর্যন্ত জটিল কোনো রোগ নিয়ে তাদের কাছে আসেনি। আসলে তারা সেটির জন্য কোনো চিকিৎসা ফি নেবেন না। এছাড়া যারা এখনো এসেছেন তাদের কোনো চিকিৎসা ফি নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন এই কর্মকর্তা।

রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় পশুর হাট সিটিহাটের ইজারাদার আতিকুর রহমান কালু এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, ঈদের আগে সাপ্তাহিক হাট হিসেবে আমদানি হয়েছে চোখে পড়ার মতো। হাটে বড় বড় ব্যবসায়ীরা এসেছেন। বেচা-কেনায় স্বচ্ছতা রাখা হয়েছে শতভাগ। হাটে ছাড় করে নিয়ে যাওয়ার জন্য বারবার বলা হচ্ছে মাইকিং করে।

রাজশাহী জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ড. জুলফিকার মোঃ আখতার হোসেন এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে বলেন, রাজশাহীতে কোরবানির জন্য প্রস্তুত হচ্ছে ৩ লাখ ৯২ হাজার ৮৫২ টি গবাদি পশু। ১৬ হাজার ৭৯ টি খামারির এসব পশু। পশুর যোগান বেশি থাকায় এবার ঈদ বাজার খামারি ও ক্রেতা উভয়ের অনুকূলে থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভারত থেকে বৈধ বা অবৈধ উপায়ে গরু আমদানি বন্ধের বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। বাইরে থেকে কোন পশু আসবে না। তাই খামারিরা ভালো দাম পাবেন। এইবার কোরবানির জন্য দেশে পর্যাপ্ত পশু রয়েছে। নিজেদের পশু দিয়েই দেশে কোরবানির পশুর চাহিদা মিটাতে পারবে। চাহিদার চেয়ে বেশি পশু আছে।

বিভাগীয় প্রাণিসম্পদ দফতরের পরিচালক নজরুল ইসলাম এগ্রিকেয়ার২৪.কমকে জানান, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় মোট কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ১৪৬০টি। এসব পশুর ২০ শতাংশ অনলাইনে আর বাঁকি ৮০ শতাংশ গরু প্রচলিত হাটে বিক্রি হবে। গতবারের তুলনায় এবার অনলাইনে সাড়া পেলেও মানুষ সরাসরি হাটে গিয়ে পশু কেনা পছন্দ করেন।

খামারিদের লভ্যাংশ কমে যাওয়ার পেছনে খাদ্যের দাম বৃদ্ধি ও সরকারের উদ্যোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার শুল্কমুক্ত পশুখাদ্য আমদানির বিষয়ে নজর দিয়েছেন। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সরকার ডেইরি খাতের দিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। খামারিদের লোকসান পুষিয়ে দিতে প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সময় সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।

আঞ্চলিক প্রাণিসম্পদ দফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজশাহী বিভাগের আট জেলায় এবারের ঈদে মোট কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে ২৭ লাখ ২৮ হাজার ১৪৬০টি। এরমধ্যে ষাঁড় রয়েছে ৭ লাখ ০৩ হাজার ৩০৭ টি, বলদ রয়েছে ২ লাখ ৮ হাজার ৯৩১টি। এছাড়া ২ লাখ ১৯ হাজার ৯৯২ গাভি, ১৬ হাজার ৬৭৩ মহিষ, ১৩ লাখ ৫৩ হাজার ছাগল এবং ২ লাখ ২৬ হাজার ৫৪৯ ভেড়াসহ অন্যান্য পশু।

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *