নিউজ ডেষ্ক- স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় দীর্ঘদিনের ভোগান্তি কমেছে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের। ঘাটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা, আর কোনও উৎসব এলে হুড়োহুড়ি করে লঞ্চে যায়গা পাওয়ার ভোগান্তি এখনও স্মরণ করলে আঁতকে ওঠেন তারা। তবে সেই দিন পাল্টে গেছে। এখন সড়কপথে খুব অল্প সময়ে সেতু পার হয়ে চলে যাওয়া যায় দক্ষিণের ২১ জেলায়। আবার দিনে দিনে রাজধানীতে এসে পৌঁছাচ্ছে দক্ষিণাঞ্চলে উৎপাদিত নানান পণ্যও। আর এর প্রভাব পড়েছে দীর্ঘ কয়েক দশকের লঞ্চ ব্যবসায়। যাত্রী সংকট আর জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে যুগ যুগ ধরে চলা ঢাকা-বরিশাল রুটের জমজমাট লঞ্চ ব্যবসায় এখন শনির দশা। রোটেশন করে চালিয়েও লাভের মুখ দেখতে পারছেন না লঞ্চ মালিকরা, তাই বাধ্য হয়েই কোটি-কোটি টাকার লঞ্চ কেটে লোহার দামে বিক্রি করা হচ্ছে।
সরজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর পোস্তগোলা শশ্মান ঘাটে ‘কামাল-১’ নামের একটি লঞ্চ কাটার কাজ চলছে। তিনতলা এই লঞ্চটির বেশিরভাগ অংশই কাটা হয়ে গেছে। বাকি অংশও কাটা হচ্ছে গ্যাসের আগুন দিয়ে। বিশাল এই লঞ্চের লোহা ও স্টিল সিটগুলো বিক্রি হচ্ছে কেজি দরে, জায়গা হবে ভাঙারির দোকানে। পরে রিফাইন করে ব্যবহার করা হবে প্রয়োজন অনুযায়ী, গলিয়ে বানানো হবে রড বা বাসা বাড়ির গ্রিল তৈরির কাজে। ইঞ্জিন ও অন্যান্য অনুষঙ্গও বিক্রি হয়েছে একইভাবে। কিছুদিন আগে একইভাবে কেটে ফেলা হয়েছে ‘রাজধানী’ নামের আরেকটি লঞ্চ। দূরেই কাটার জন্য অপেক্ষায় আছে ‘প্রিন্স সাকিন-৪’ নামের লঞ্চটি।
ঘাটের কন্ট্রাক্টার ও শ্রমিকদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পোস্তগোলার শশ্মান ঘাটটি আগে ব্যবহার হতো লঞ্চ নির্মাণ ও মেরামতের জন্য। বর্তমানে ঘাটটি ব্যবহার হচ্ছে লঞ্চ কাটার জন্য। বেশ কয়েকটি কাটা হয়েছে, আরও কয়েকটি লঞ্চ কাটা হবে, কথাবার্তা চলছে। দরদাম চূড়ান্ত হলেই সেসব লঞ্চের জায়গা হবে এই ঘাটে।
এসব লঞ্চের কন্ট্রাক্টর হাসান বলেন, ‘আমরা কন্ট্রাক্ট নিয়ে লঞ্চ কেটে দেই। প্রতিটি লঞ্চে গড়ে ১০-১২ লাখ টাকার মজুরি খরচ হয়। তেলের দাম বাড়ার পর থেকে পুরনো লঞ্চগুলো কেটে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। মালিকদেরতো আর কিছু করার নেই। ৫০ কোটি টাকার বেশি খরচ করে লঞ্চ বানিয়ে ২-৫ কোটি টাকায় কেটে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। সামনে আরও লঞ্চ কাটার জন্য আসবে, কন্ট্রাক্ট নিয়ে দামদর চলছে।’
লঞ্চ কাটায় কাজ করছেন মোবারক নামের এক শ্রমিক। তিনি বলেন, ‘লঞ্চ কেটে লোহা কেজি দরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। কাটার পর এখান থেকেই বিক্রি হয়ে যায়। যারা কিনে এখান থেকে নিয়ে যায়। ইঞ্জিনও বিক্রি করে দেয়। আবার অনেকে ইঞ্জিন রেখেও দিচ্ছে। এই ইঞ্জিনতো আর অন্য কোথাও ব্যবহার করা যায় না। নতুন লঞ্চ হলে সেক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয়।’
দীর্ঘদিন এখানে নতুন নতুন লঞ্চ বানানো হলেও এখন আর নতুন লঞ্চ বানানো হচ্ছে না। অন্তত গেল কয়েক মাসে নতুন একটি লঞ্চও বানানো হয়নি। বরং সম্প্রতি নির্মাণাধীন একটি বিলাসবহুল লঞ্চের ৩০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর সেটি কেটে ফেলা হয়েছে। আরেক শ্রমিক সাইফুদ্দিন বলেন, ‘তেলের দাম বাড়ার পর সবকিছুর দামই বেড়ে গেছে, যাত্রীও নেই। নতুন লঞ্চ বানিয়ে কি করবে? বরং যেসব লঞ্চ তৈরি হচ্ছিলো সেগুলো বন্ধ আছে। একটা ভিআইপি লঞ্চ বানানোর কাজ শুরুর পর সেটা আবার কেটে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে।’
জহুরুল নামের আরেক কর্মচারী বলেন, ‘একটা লঞ্চ কাটতে ৪০-৫০ দিনের মতো সময় লাগে। এখন কামাল-১ কাটছি ২০-২২ দিন ধরে। এরপর প্রিন্স সাকিন-৪ কাটা হবে।’
তবে শুধু যাত্রী কমাই লঞ্চ কাটার একমাত্র কারণ নয়। লঞ্চ সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, রাজধানীর সদরঘাট থেকে বিভিন্ন রুটে চলাচল করা লঞ্চগুলোর অধিকাংশরই ফিটনেস ছিল না। ফিটনেস সমস্যা নিয়ে সহজে অন্য রুটে পারমিট না পাওয়ায় চাইলেও বিক্রি করা সম্ভব হচ্ছে না লঞ্চগুলো। ফলে বাধ্য হয়েই কেটে ফেলে বিক্রি করতে হচ্ছে কোটি কোটি টাকা দামের এসব লঞ্চ।
সার্বিক বিষয়ে লঞ্চ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক বলেন, ‘আমার নিজেরেই একটা লঞ্চে তেলের ৪৭ হাজার টাকা বাকি পড়েছে। সবাই লোকসানে আছে। আগে যেখানে দিনে ৭-৮টা লঞ্চ যেতো, এখন রোটেশনে তিনটা করে চালানো হচ্ছে তারপরও টাকা উঠছে না। তেলের দাম বেড়েছে এটা যেমন সমস্যা, আরও বড় সমস্যা ভেজাল তেল। এখন যে তেলটা আমরা পাচ্ছি কেরোসিনের মতো পাতলা। ফলে দ্রুত জ্বলে যাচ্ছে, ২-৩ ব্যারেল তেল বেশি লাগছে আবার ইঞ্জিনেরও ক্ষতি হচ্ছে। লঞ্চের মেইনটেইন খরচ ছাড়াও আমাদের কর্মচারীদের বেতন দেওয়ার বিষয় আছে। সব মিলিয়ে আমরা বিপাকে।’
সামনে কতগুলো লঞ্চ এভাবে কাটা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার নিজেরই দুইটা লঞ্চ কাটা হবে, কথাবার্তা চলছে। পোস্তগোলায় কয়েকটা লঞ্চ কাটার কাজ চলছে, সামনে আরও ৪-৫টা ওখানে যাবে, কিছু লঞ্চ সদরঘাটের ওই পাড়ে কাটা হবে, কথা চলছে। বিশেষ করে মাঝারি ও ছোটো সাইজের অধিকাংশ লঞ্চই হয়তো কাটা পড়বে। আমাদের তো ব্যবসা চালাতে হবে, যাত্রী না থাকলে লঞ্চ রেখে কী হবে? সামনে লোহার দাম কমে গেলেতো এখন কেটে যে টাকা পাবো সেটাও পাওয়া যাবে না।’ সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন