নিউজ ডেষ্ক- কক্সবাজার জেলা কারাগার। এ যেন অন্য এক দুনিয়া। চোখে না দেখলে কারাগারের ভেতরকার কাজ কারবার যে কারওর কাছেই অবিশ্বাস্য মনে হবে। কথিত আছে, এখানে টাকা দিলে বাঘের চোখও মেলে! খাওয়া যায় মাদক থেকে শুরু করে মাংস-পোলাও। মোবাইল ফোনে বউ থেকে শুরু করে প্রিয়জন কিংবা বন্ধুর সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে নেই মানা! বাইরে থেকে টের পাওয়া না গেলেও কারাগারের ভেতরে গড়ে উঠেছে অবৈধ ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এসব অপকীর্তির হোতা জেলার নেছারুল আলমসহ কারগারের কিছু অসাধু কর্মকর্তা। কারাগারটি থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া বেশ কয়েকজন বন্দির কাছ থেকে পাওয়া গেছে এমন তথ্য।
নুরুল আমিন (ছদ্মনাম) নামের এক ব্যক্তি করোনার মধ্যে কক্সবাজার কারাগারে বন্দি ছিলেন ৫ মাস। সেখানকার অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনার কারণে এখন বন্দিদের সঙ্গে স্বজনদের দেখা করা কাগজে-কলমে নিষিদ্ধ। তবে কথিত ভিআইপি ব্যবস্থাপনায় সবই সম্ভব। আর স্বাভাবিক সময়ে টাকা দিলেই ভিআইপি ব্যবস্থাপনা ছাড়াই স্বজনরা বন্দিদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন। পাশাপাশি আসামিদের জন্য বাড়ির রান্না করা খাবার ঢোকাতে পারেন। এজন্য আছে আলাদা কক্ষের ব্যবস্থা। ডেপুটি জেলারের কক্ষই সাক্ষাতের কক্ষ হিসাবে ব্যবহার করা হয়।
নুরুল আমিন আরও বলেন, ‘করোনার সময় দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ থাকলেও পাঁচ থেকে বিশ হাজার টাকা দিলে ভেতরে বসে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেওয়া হতো। সবাই দেখা করার সুয়োগ না পেলেও ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা হেলাল সুবেদারের মাধ্যমে বাইরের যে কারও সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলার সুযোগ ছিল ওপেন সিক্রেট।
ইয়াবা সিন্ডিকেটের দখলে মোবাইল ফোন : সদ্য কারামুক্ত কয়েকজন বন্দি জানান, সরকার সাধারণ বন্দিদের জন্য কারাগারে ১৬টি মোবাইল ফোন দিয়েছে। নিয়ম অনুয়ায়ী ৫ টাকা দিয়ে প্রত্যেক বন্দি সপ্তাহে একবার পরিবারের (এক কল) সঙ্গে ১০ মিনিট করে কথা বলতে পারেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ প্রতি ১৫ দিনের জন্য আড়াই লাখ টাকা জামানত (অফেরতযোগ্য) নিয়ে ৮টি মোবাইলই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের কাছে ভাড়া দিয়ে রেখেছে। এসব মোবাইলের ভাড়া বাবদ আদায় করা হয় দৈনিক ৮০ হাজার টাকা। ওই মোবাইলে কথা বলতে বন্দিদের প্রতি ৫ মিনিটের কলে ২০০ টাকা করে নিচ্ছে তারা।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের টেলিফোন অবৈধভাবে লিজ দেওয়া হয়েছে ইয়াবা কারবারিদের কাছে। দৈনিক ৮০ হাজার টাকার বিনিময়ে এ লিজ নিয়েছে ইয়াবা ব্যবসায়ীদের একটি সিন্ডিকেট।
সরকারি হিসাবে দৈনিক গড়ে আসামিদের সঙ্গে ৬০০ থেকে সাড়ে ৬০০ লোক কথা বলার নিয়ম থাকলেও এ কারাগারে দৈনিক কথা বলেন ১৫শ জন। এছাড়া নিয়মবহির্ভূত ভাবে চলছে মোবাইল বাণিজ্য। এছাড়া নতুন বন্দিদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের অভিযোগ আছে। নতুন যারা কারাগারে ঢোকেন তাদের কোয়ারেন্টিনের নামে সেলে রেখে জনপ্রতি ৫ হাজার থেকে শুরু করে ২০ হাজার টাকা আদায় করেন সুবেদার হেলাল। অর্থাৎ টাকা দিলে কোয়ারেন্টিনে থাকার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু টাকা না দিলে ভোগান্তির শেষ থাকে না।
এদিকে আসামিরা সাধারণ ওয়ার্ডের কোথায় থাকবেন, কতটা ভালো থাকবেন, কী খাবার খাবেন-তা নির্ভর করে হেলাল সুবেদার সিন্ডিকেটের ওপর। টাকার পরিমাণ বিবেচনায় নতুন আসামিদের সুযোগ-সুবিধা করে দেয় এ সিন্ডিকেট। টাকা দিতে রাজি না হলে নতুন বন্দিদের অহেতুক আলাদা করে রাখা হয়। টাকা আদায় না হওয়া পর্যন্ত খাবার ও গোসল ঠিকমতো করতে দেওয়া হয় না।
কারাগারে যেভাবে ঢুকে টাকা : হাজতি বা কয়েদিদের নগদ টাকা প্রয়োজন হলে কারারক্ষীদের মাধ্যমে যত টাকা ইচ্ছা কারাগারে ঢুকানো যায়। এক্ষেত্রে প্রতি হাজারে কারারক্ষীদের কমিশন দিতে হয় ২০০ টাকা।
কারা হাসপাতাল ইয়াবা ব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণে : কক্সবাজার কারাগারে দোতলা একটি হাসপাতাল আছে। সেখানে অসুস্থ কারাবন্দিরা ঠিকমতো চিকিৎসা পান না। ওষুধ চাইলে পরে দেওয়া হবে, নতুবা নেই বলে খালি হাতে ফেরত পাঠানো হয়। হাসপাতালের ওষুধ বিক্রি ও বন্দিদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে ফার্মাসিস্টের বিরুদ্ধে।
অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল বন্দিরা মাসিক ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা করে ফার্মাসিস্টদের দায়িত্বে থাকা কারারক্ষী নাসিরকে দিয়ে হাসপাতালে আবাসিক হোটেলের মতো বাস করেন। খাবারও খান ভালোমানের। আর প্রকৃতপক্ষে যারা অসুস্থ তাদের হাসপাতালের মেঝেতে ফেলে রাখা হয়। অভিযোগ রয়েছে, ওই হাসপাতালে স্থায়ী কোনো চিকিৎসক নেই। সরকারি অন্য হাসপাতালে কর্মরত একজন চিকিৎসক মাঝেমধ্যে কারা হাসপাতাল আসেন। ইয়াবা ব্যবসায়ীরা টাকার বিনিময়ে কারা হাসপাতাল তাদের দখলে রেখেছে।
জেলখানার ভেতরে একপাশে তৈরি করা হয়েছে কারা ক্যান্টিন। সেখানে কয়েকশ হাজতি ও কয়েদির পছন্দমতো খাবার রান্না হয়। ক্যান্টিনে ন্যায্য দামে পণ্য বিক্রির নিয়ম থাকলেও ৫-১০ গুণ দাম নেওয়া হয়। ৭০০ বন্দির ধারণক্ষমতার কারাগারে বর্তমানে চার হাজারের বেশি বন্দি থাকেন। বন্দিদের জন্য দৈনিক খাদ্য তালিকা অনুযায়ী খাবার সরবরাহ করা হয় না।
ক্যান্টিন ও ওয়ার্ডে সিট বাণিজ্য : সদ্য কারামুক্ত একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, কারাগারের সাগর ভবন আমদানি ওয়ার্ড নামে পরিচিত ১নং ওয়ার্ডে ১০০ আসামি থাকেন। সেখানে প্রতিজনের কাছ থেকে মাসে নেওয়া হয় ৩ হাজার টাকা করে। অন্য ভবনগুলোতে প্রতিমাসে দিতে হয় দুই হাজার টাকা করে। সব ওয়ার্ডে একই অবস্থা। হাসপাতালে সাধারণ বন্দিদের চিকিৎসার কোনো সুযোগ নেই। সেখানে মোটা অঙ্কের বিনিময়ে মাসের পর মাস থাকে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। তাদের খাবার ও রান্না করা হয় হাসপাতালের রান্নাঘরে।
একজন কারারক্ষী জানান, ভেতরে থাকা কেন্টিন কারারক্ষীদের ভাড়া দেওয়া হয়। এজন্য প্রতি ২ মাসে ১০ লাখ টাকা ঘুস ছাড়াও মাসে ২৫ লাখ টাকা করে ভাড়া দিতে হয় জেল সুপারকে। টাকা তোলার দায়িত্বে রয়েছেন সুবেদার হেলাল হোসাইন, জেল সুপারের ড্রাইভার কবির ও তার দেহরক্ষী অসিম।
অনুসন্ধানে জানা যায়, কারাগারের বন্দিদের প্রাপ্য সরকারি বরাদ্দ করা চাল, ডাল, তেলসহ অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের সিংহভাগই লুটপাট হয়। নির্দেশনা অনুসারে প্রতিদিন সকাল, দুপুর, বিকালে যে পরিমাণ খাবার পাওয়ার কথা তা কখনোই দেওয়া হয় না বন্দিদের।
জেল থেকে মুক্তিপ্রাপ্তরা জানান, জেল সুপার নেছারুল আলমের ইচ্ছে অনুযায়ী রান্না হয়। কেউ প্রতিবাদ করলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। মাছের মাথা দিয়ে সবজি রান্না, ব্রয়লার মুরগি দিয়ে ডাল এবং দুপুরের সবজির বদলে আলু রান্না করে খাওয়ানো হয়। আর এসব তরকারি বিতরণের সময় জেল সুপারের সিন্ডিকেটের সদস্য সুবেদার হেলাল হোসাইন নিজে উপস্থিত থাকেন। যেন কোনো বন্দি এর প্রতিবাদ করতে না পারেন। কেউ প্রতিবাদ করলে তার ওপরে নেমে আসে নির্যাতন।
অভিযোগের বিষয়ে সুপারের বক্তব্য : জানতে চাইলে জেল সুপার নেছারুল আলম বলেন, ‘আমার কারাগারে মোবাইল, ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট চালু থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব।’ আপনি কারাগারের ক্যান্টিন থেকে প্রতিমাসে ২৫ লাখ টাকা নেন- এমন প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে যান তিনি। গরুর মাংস কেজি দুই হাজার দুইশ ও মুরগির মাংস কেজি এক হাজার দুইশ টাকা ও আলুর কেজি দুইশ টাকা বিক্রি হয় কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, বিষয়টি দেখে ব্যবস্থা নেব।
কারাগারে ইয়াবা ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট মোবাইল কলের ব্যবসা করে এবং প্রতিদিনই আপনাকে ৮০ হাজার করে টাকা দিতে হয়-এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রতিবেদককে ভাই বলে কারাগারের বিরুদ্ধে সংবাদ প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান।
সুবেদার হেলাল হোসাইনের কোয়ারেন্টিন ও সিট বাণিজ্য প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে তিনি রেগে গিয়ে বলেন, কক্সবাজার কারাগারের সুনাম নষ্ট ও অস্থিতিশীল করতে এসব অভিযোগ আনা হয়েছে।