নিউজ ডেস্ক– বাংলাদেশ বিমানবন্দরের একজন সাব-ইনস্পেকটরের (এসআই) সোনা চোরাচালানে জড়িত থাকার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। তার নাম মিরাজুল ইসলাম। ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিদেশ থেকে পাচার হওয়া স্বর্ণ উদ্ধারের দায়িত্ব ছিল তার হাতে। ‘রক্ষক হয়ে ভক্ষক’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে নিজেই জড়িয়ে যান স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে।
সম্প্রতি দুবাই থেকে স্বর্ণের বড় চালান নিয়ে ঢাকায় আসার পথে তিনি সাতজন সহযোগীসহ কাঠমান্ডুতে আটক হন। ঘটনা এখানেই শেষ নয়। একে একে দৃশ্যপটে আসেন পর্দার আড়ালে থাকা দুবাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের আরও বড় বড় ‘গডফাদার’।
মিরাজুলসহ তিনজনকে ছাড়িয়ে নিতে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দুবাই থেকে জরিমানার ৭৬ লাখ নেপালি রুপি নিয়ে কাঠমান্ডুতে হাজির হন তারা। এরপর ৮ জানুয়ারি তারা মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে আসেন। ততক্ষণে পানি অনেক গড়িয়ে গেছে। বাংলাদেশ ও নেপালের সরকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় জড়িয়ে পড়ে।
নেপালে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এই ঘটনা নিয়ে তোলপাড় হচ্ছে। দুবাইয়ের সোনা চোরাচালানিরা কাঠমান্ডুকে ট্রানজিট হিসাবে ব্যবহার করায় নেপালের উচ্চপর্যায়ে টনক নড়েছে। নেপালি কর্তৃপক্ষ ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নজরদারি জোরদার করেছে। নেপালে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সালাউদ্দিন নোমান চৌধুরী নেপালের অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপর ঘটনার পুরো বর্ণনা দিয়ে ঢাকায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মোস্তফা কামালের কাছে চিঠি লেখেন। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান, পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব), নিরাপত্তা সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালকের কাছে অনুলিপি পাঠান। ঢাকার একটি সূত্র থেকে চিঠির কপি যুগান্তরের হাতে আসার পর কাঠমান্ডুতে সরেজমিন অনুসন্ধান চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
নেপালের কাস্টমস কর্তৃপক্ষ স্বর্ণ চোরাচালানে জড়িত থাকায় যে আটজন বাংলাদেশিকে আটক করেছে; তাদের মধ্যে কেবল এসআই মিরাজুল বাংলাদেশের সরকারি পাসপোর্ট বহন করছিলেন। বাকিরা সাধারণ বাংলাদেশি পাসপোর্ট বহন করেন।
আটক ব্যক্তিরা হলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশনের এসআই মো. মিরাজুল ইসলাম (বাংলাদেশি অফিশিয়াল পাসপোর্ট নম্বর ওসি৬০০৯০৮৩), সালমান আহমেদ (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিটি০২১২১৫৪), মো. ইউনুস আলী (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিকিউ০৩৯৩২৮৮), জাহিদুল ইসলাম (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর এও০১০০৮৮৫), তৌহিদুল তানভীর (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর এও১২৪১৪৬৯), সোবহান তালুকদার (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিটি০৬৯৩৫৯৯) ও আশরাফুল ইসলাম (বাংলাদেশি পাসপোর্ট নম্বর বিএন০৯৮৭৭১)।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, তারা নেপালের বেসরকারি হিমালয়ান এয়ারলাইন্সে দুবাই থেকে কাঠমান্ডু হয়ে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। তারা বিভিন্ন গ্রুপের সঙ্গে মিলে গেলেও কাঠমান্ডুতে অবস্থিত ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ট্রানজিট এলাকায় ঘোরাফেরার সময় নেপালের কাস্টমস কর্তৃপক্ষের সন্দেহ হয়। তখনই তাদের আটক করা হয়। তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে সোনার বার, স্বর্ণালংকারসহ ৪০ ভরি করে সোনা ছিল। বাংলাদেশের ব্যাগেজ রুল অনুযায়ী বিমান ভ্রমণকালে কেউ দশ ভরির বেশি স্বর্ণালংকার পরিধান করতে পারেন না। এর বাইরে দশ ভরির বেশি সোনার বার বহন করতে পারেন না। ফলে একজন বিমানযাত্রী স্বর্ণালংকার, বারসহ মোট ২০ ভরি পর্যন্ত স্বর্ণ বহন করতে পারেন। যদিও আশপাশের দেশে ব্যাগেজ রুলে পাঁচ থেকে দশ ভরি পর্যন্ত স্বর্ণ বহনের নিয়ম আছে। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে বাংলাদেশের ব্যাগেজ রুলে অধিক স্বর্ণ বহনের অনুমতি আছে।
আটক ব্যক্তিরা বাংলাদেশি হওয়ায় কাঠমান্ডুতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস তাদের মুক্তির জন্য নেপালি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা শুরু করে। বাংলাদেশ দূতাবাসের তরফে যুক্তি দেখানো হয় যে, আটক ব্যক্তিরা ট্রানজিট যাত্রী। ফলে তারা নেপালের আইনের আওতাধীন নয়। তাদের মুক্তির লক্ষ্যে রাষ্ট্রদূত নিজে নেপালের অর্থমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সময় নেপালের অর্থমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র সচিব জানান, আটক ব্যক্তিদের তিনজন মুক্তির জন্য নেপালের কর্তৃপক্ষের কাছে ৭৬ লাখ নেপালি রুপি পরিশোধ করেছেন। জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো চিঠিতে রাষ্ট্রদূত মন্তব্য করেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে এত বেশি জরিমানার অর্থ পরিশোধের মাধ্যমে তাদের একটি চক্রের সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয় নিশ্চিত করে। আটক অবশিষ্ট ব্যক্তিদের দূতাবাস বন্ড সই দিয়ে আদালত থেকে ছাড়িয়ে আনে। তারা পাসপোর্ট ফিরে পাওয়ার পর বাংলাদেশে ফিরেন।
রাষ্ট্রদূত চিঠিতে উল্লেখ করেন, অফিশিয়াল পাসপোর্টধারী ব্যক্তি পুলিশের একজন এসআই। তিনি বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজ করেন। তার জামিনের জন্য ৩৩ লাখ নেপালি রুপি জরিমানা দিয়েছেন। নেপালের কর্তৃপক্ষ বাংলাদেশকে জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিরা শক্তিশালী পাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। এই চক্রের সঙ্গে নেপালের কেউ জড়িত কি না, তা যাচাই করতে তারা আটকদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। পাশাপাশি তারা এও জানান, সোনা চোরাচালানের বিষয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক করাও তাদের আটক করার অন্যতম কারণ। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের ব্যাগেজ রুল অনেক বেশি নমনীয়। পাচারকারীরা এই নিয়মের সুযোগ নিয়ে থাকে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত স্বর্ণ পাচার রোধে তিনটি সুপারিশের কথা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন। দেশে ফেরার সময়ে বাংলাদেশি অভিবাসীদের ব্যবহার করে স্বর্ণ পাচারের সঙ্গে একজন সরকারি কর্মকর্তা কীভাবে জড়িত হলেন, এর পরিপূর্ণ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের ব্যাগেজ রুল পরিবর্তন করা প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সোনা পাচার রোধে বিমানবন্দরে নজরদারি আরও জোরদার করতে হবে।
কাঠমান্ডুতে জিজ্ঞাসাবাদে এসব বাংলাদেশি স্বর্ণ পাচারে জড়িত বলে স্বীকার করেছেন। তবে চক্রটি নিরীহ বাংলাদেশিদের মাধ্যমেও স্বর্ণ পাচার করিয়েছে বলে স্বীকার করেছে। আটক আটজনের মধ্যে দুইজন জানিয়েছেন, তারা ওই চক্রের অনুরোধে স্বর্ণ বহন করছিলেন। স্বর্ণ বহন করার বিনিময়ে তারা প্রত্যেকে ১০ হাজার টাকা করে নগদ অর্থ পাবেন বলে প্রলোভন দেখিয়েছিল। সেই লোভের বশবর্তী হয়ে তারা স্বর্ণ বহন করেন বলেও জানান।
এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সরেজমিন দেখা যায়, সোনা চোরাচালান প্রতিরোধে নিরাপত্তাব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তারা হ্যান্ডমাইক নিয়ে ঘোষণা করছেন কারও কাছে স্বর্ণের বার থাকলে তা ঘোষণা দেওয়ার জন্য। কিন্তু বিমানবন্দরে কর্মরতদের সহায়তা নিয়ে অনায়াসে সোনা পাচার সম্ভব। অবাধে সোনা পাচারের কারণে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিদেশে বিনষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে ইমিগ্রেশনের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পাচারে যুক্ত হওয়ার ঘটনায় সবাই বিস্মিত।