গাছ থেকে বিদায় নিয়েছে সোনালী মুকুল। পরিণত হয়ে জায়গা দখল করেছে মার্বেল আকৃতির সবুজ গুটি। এই আমের কচি গুটিতেই স্বপ্ন বুনছেন হাজারো স্বাপ্নিক চাষি। রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ ও নাটোর জেলা নিয়ে গঠিত হয়েছে রাজশাহী কৃষি অঞ্চল। এ অঞ্চলে এবার রেকর্ড পরিমাণ আম উৎপাদনের আশা করছেন এখানকার আমবাগানি ও আমচাষিরা।
করোনাকালীন সময়ে আমের বিপণনে সমস্যা হওয়ায় গত বছর ভালো দাম পাননি তারা। সেইসাথে ফলন তুলনামূলক কম হয়। তবে, গত বছরের লোকসান পুষিয়ে নেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এবার। সেইলক্ষ্যে আমের পরিচর্যায় ব্যস্ত অভিজ্ঞ চাষিরা। এদিকে চাষিদের প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করছে কৃষি বিভাগ।
রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, আমের মুকুল শেষ হয়ে বর্তমানে গুটি আসতে শুরু করেছে। বড় ধরণের দূর্যোগ না হলে গতবছরের তুলনায় এবার ভালো ফলন হবে। কৃষি বিভাগ আরো জানায়, এবার রমজানের পর আম পাকতে শুরু করবে। রোজার পর আম পাকলে চাষিরা তাদের আশানুরুপ দাম পাবেন। সেইসাথে বিপণনে সুবিধে হবে।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী কৃষি অঞ্চলে চলতি মৌসুমে আমবাগান রয়েছে ৮৪ হাজার ৩৮৮ হেক্টর। এর মধ্যে আমের নতুন রাজধানী নওগাঁ জেলায় ২৫ হাজার ৮৫০ হেক্টরে জমিতে ৩ লাখ ৪৮ হাজার ৯৭৫ টন আম উৎপাদন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া রাজশাহী জেলায় ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর জমিতে ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৮ টন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৩৪ হাজার ৭৩৮ হেক্টরে ৩ লাখ ৮২ হাজার ১১৮ ও নাটোরের ৫ হাজার ৮৫৭ হেক্টরে জমিতে ৮২ হাজার ৩৯৩ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশা মনে করছেন কৃষি বিভাগ।
এদিকে রাজশাহী জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র অনুযায়ী, ২০২০-২১ মৌসুমে জেলায় আমবাগান ছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর। সেবার মোট উৎপাদন হয় ২ লাখ ১৭ হাজার ১২৮ টন। প্রায় ৮৬ কোটি ৮৫ লাখ ১২ হাজার টাকার আম বিক্রি হয়। ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজশাহী জেলায় মোট আমবাগান ছিল ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর। ওই মৌসুমে আম উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪০ দশমিক ৫৩ টন। ওই মৌসুমে আম বাণিজ্য হয় প্রায় ৭১ কোটি ৮১ লাখ ৬২ হাজার টাকার।
জেলার বাঘা উপজেলার পাকুড়িয়া এলাকার চাষী আরমান হোসেন জানান, ‘এ বছর আমের বাগানে একটু কম মুুকুল মনে হচ্ছে। যারা বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ করে তাদের একটু সমস্যা হবে। তবে, এখন গুটি শুরু হয়েছে। গুটি মার্বেলের আকার ধারণ করেছে। সামনে আবার কালবৈশাখী ঝড় আছে। ঝড়ের পর আসলে বোঝা যাবে কি হবে। আশা করছি, গতবারের তুলনায় আমের ভালো দাম পাওয়া যাবে।
পবা উপজেলার আম ব্যবসায়ী ও আম চাষী মোর্তজা আহম্মেদ জানান, ‘আমি প্রতিবছরই আম চাষ করি। এবারও আশা করি ভালো ফলন হবে। আমরা চাষীরা মুকুল আসার আগে থেকেই গাছের পরিচর্যা করি। মটর দানা থেকে আম এখন আরো একটু বড় হয়েছে। আসল পরিচর্যা শুরু হয়েছে। এবার রোজার পর আম পাকবে ফলে দাম নিয়ে চিন্তা নাই।
এদিকে নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার চাষি মহিদুল বলেন, নওগাঁতেও আমের ফলন দিন দিন বাড়ছে। নতুন বাগানের গাছগুলোতেও এবার মুকুল এসেছে। ল্যাংড়া, গোপালভোগ, ক্ষিরসাপাতি, বোম্বাই, হিমসাগর, ফজলি, আম্রপালিসহ বিভিন্ন জাতের আমের চাষ হয় নওগাঁয়।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্র সূত্র জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে রাজশাহী জেলায় ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে আম আবাদ হয়েছে, ফলনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ লাখ ১৭ হাজার টন, যার বাজারমূল্য প্রায় ৮৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। গত বছর ১৭ হাজার ৬৮৬ হেক্টর জমিতে আম আবাদ হয়েছিল। হেক্টরপ্রতি গড় ফলন হয়েছিল ১১ দশমিক ৯৬ টন। মোট উৎপাদন হয়েছিল ১ লাখ ৭৯ হাজার ৫৪০ দশমিক ৫৩ টন আম, যার বিক্রয়মূল্য ছিল প্রায় ৭১ কোটি ৮১ লাখ ৬২ হাজার ১২০ টাকা।
রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন জানান, চলতি মৌসুমে আমের মুকুল বেশি হয়েছে। সাধারণত আমগাছে মুকুল আসার পর হপার পোকার আক্রমণ দেখা দেয়। সে ক্ষেত্রে নিয়মানুযায়ী পোকা মারা কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করেছেন চাষীরা।
তিনি আরোও জানান, ম্যানকোজেব জাতীয় ছত্রাক নাশক এবং ইমিটাক্লোপিড জাতীয় কীটনাশক প্রতি লিটার পানিতে (ম্যানকোজেব ২ গ্রাম ও ০.৫ মিলি ইমিটাক্লোপিড) তিন বার স্প্রে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। একবার মুকুল আসার আগে, মুকুল ফোটার আগে এবং আম মটর দানার মতো হলে। রাজশাহীর আম চাষীরা আগে থেকেই যেহেতু অভিজ্ঞ সেহেতু তারা খুব সহযেই আমের যত্ন নিতে পারেন বলে জানান এই কর্মকর্তা।