হাসিনার পতন নিয়ে ভারতীয় মিডিয়ার নতুন প্রোপাগান্ডা

সারাদেশ

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন নিয়ে এবার নতুন প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নর্থইস্ট নিউজ ইন্ডিয়া।

হাসিনার পতনের এক বছর পর আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দিনগুলোতে ভেতরের পরিস্থিতি নিয়ে নতুন এক দৃশ্যকল্প হাজির করেছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমটি।

সাংবাদিক চন্দন নন্দী ওই প্রতিবেদনে দাবি করেছেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা ক্ষমতা হারানোর কয়েক মাস আগে থেকেই তার সরকারের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে ‘প্রভাবিত’ করেছিল মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’। সেই সঙ্গে তাদের এমনভাবে পরিচালিত করেছিল, যাতে তাদের কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগ সরকারের ‘স্বার্থের বিরুদ্ধে’ যায়।

সেই তিনজন হলেন শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত।

যদিও এ বক্তব্যের ব্যাপারে কোনো প্রমাণ উপস্থাপন করেননি তিনি। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টিকে অসত্য বলে মন্তব্য করছেন খোদ আওয়ামী সমর্থকরাই।

নর্থইস্ট নিউজ লিখেছে, ‘শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঠেকাতে শেখ হাসিনার সরকার ও আওয়ামী লীগ কেন ব্যর্থ হয়েছিল, তার বিশ্লেষণে বেরিয়ে আসে ওই তিন ব্যক্তির রহস্যজনক ভূমিকার কথা, যা মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’এর লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এগিয়ে নিতে ভূমিকা রেখেছিল।’

ওই বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলেন শেখ হাসিনা। আর ১৩ আগস্ট রাতে ঢাকার সদরঘাট এলাকা থেকে সালমান এফ রহমান ও আনিসুল হককে গ্রেপ্তার করার কথা বলা হল।

ভারতীয় পত্রিকাটি লিখেছে, আরাফাত তার ‘পশ্চিমা যোগাযোগ’ কাজে লাগিয়ে বিদেশে পালিয়ে গেছেন বলেই অনেকের ধারণা; তবে তার অবস্থান সম্পর্কে তেমন কোনো তথ্য জানা যায় না।

নাম প্রকাশ না করে আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে নর্থইস্ট নিউজ লিখেছে, হাসিনা সরকারের শেষ কয়েক সপ্তাহে সালমান রহমান, আনিসুল হক এবং আরাফাত ‘এমন কর্মকাণ্ড’ করেছিলেন, যা সামগ্রিকভাবে সরকারের, বিশেষ করে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর ‘স্বার্থের ক্ষতি’ করেছে।

শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার একজন জ্যেষ্ঠ মন্ত্রী পত্রিকাটিকে বলেছেন, ‘দরবেশ’ নামে পরিচিতি পাওয়া সালমান এফ রহমানের সঙ্গে মার্কিন কর্মকর্তাদের বৈঠকের বিষয়ে তিনি অবহিত ছিলেন।

সাবেক ওই মন্ত্রীর ভাষায়, ‘দরবেশ’ কার্যত শেখ হাসিনার কাছ থেকে তাদের ‘দূরে সরিয়ে’ রেখেছিলেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওই তিনজন যে ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ করতে পারেন, শেখ হাসিনা কখনোই তা ‘সন্দেহ করেননি’। তবে এখন তিনি তাদের ভূমিকা সম্পর্কে ‘অবগত’।

আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের কথিত তৎপরতার সূচনা নিয়ে দুই রকম তথ্য পাওয়ার কথা লিখেছে নর্থইস্ট নিউজ।

একটি পক্ষ বলেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকেই মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’ বাংলাদেশের ‘ক্ষমতার পট পরিবর্তনের’ পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামে।

আরেকটি পক্ষ বলেছেন, সেই পরিকল্পনা কার্যকর করা শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের এপ্রিল-মে মাসে, যখন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর এবং ঢাকায় তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাসসহ দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়ার সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু ‘অবাধ ও মুক্ত’ নির্বাচনের ব্যাপারে প্রকাশ্য আলোচনা শুরু করেছিলেন।

২০২২ সালের ২ জুন ভারতের একটি কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে নর্থইস্ট নিউজ লিখেছে, “ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস, যিনি বাংলাদেশকে বারবার গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, তিনিও শেখ হাসিনার সরকার উৎখাতের বিস্তৃত পরিকল্পনার অংশ।

“২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে শেখ হাসিনা যখন শেষবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন, তখন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে মার্কিন ‘ডিপ স্টেট’ তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে চাইছে।”

ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সে সময় দলের ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শেখ হাসিনা তার সরকারের সামনে ছয়টি ‘জটিল সমস্যার’ কথা তুলে ধরেন, যেগুলো ‘মার্কিন চাপ থেকে’ উদ্ভূত।

এর মধ্যে ছিল কোয়াডে যোগদানের প্রস্তাব, জিইওএসওএমআইএ এবং এসিএসএ চুক্তিতে স্বাক্ষর, আমেরিকান কোম্পানিগুলিকে ২৬টি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ অঞ্চলে অনুসন্ধান ও উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া এবং মার্কিন ‘বার্মা অ্যাক্ট’ অনুযায়ী মিয়ানমার সীমান্ত সমস্যার সমাধানের মত বিষয়।

এক আওয়ামী লীগ নেতাকে উদ্ধৃত করে ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়, সেই বৈঠকে কথা বলার সময় শেখ হাসিনাকে ‘উদ্বিগ্ন’ মনে হচ্ছিল, যেন তিনি নিজের সরকারের সামনে হুমকি দেখতে পাচ্ছিলেন।

“দরবেশ আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানে উঠে এসে কার্যত উপ-প্রধানমন্ত্রীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, শেখ হাসিনার প্রতি তিনি কড়া নজর রাখছিলেন। লক্ষ্য রাখছিলেন, তিনি কার সঙ্গে কথা বলছেন বা কার সঙ্গে সাক্ষাৎ করছেন।

সালমান শেষবার যুক্তরাষ্ট্র সফর করেছিলেন ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে, তখন মার্কিন বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার সঙ্গেও তিনি বৈঠক করেন।

নর্থইস্ট নিউজ বলছে, ওই বছরের শেষে প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য এবং ফরেন অ্যাফেয়ার্স কমিটির সদস্য গ্রেগরি ওয়েলডন মিকসের চিফ অব স্টাফ নিউ ইয়র্কে আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে বলেছিলেন, ‘ছয় মাসের মধ্যে’ বাংলাদেশে কোনো ‘বড় ঘটনা’ ঘটতে পারে।

আওয়ামী লীগের একটি সূত্রকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাটি লিখেছে, “শেখ হাসিনা তার বিরুদ্ধে পাকানো এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে সামান্য ধারণাও পাননি। কয়েক মাস আগে (২০২৫ সালে) আমার যখন তার সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হল, আমি যা যা তথ্য জোগাড় করতে পেরেছি, তার বিস্তারিত শেখ হাসিনার কাছে বললাম। ওই ষড়যন্ত্রের বিস্তৃতি ও গভীরতা কতটা ছিল, আমি যখন তাকে বলছিলাম, তখন তার মুখের পেশীগুলো কাঁপছিল। এরপর তিনি আমাকে একটা লিখিত প্রতিবেদন তৈরি করার নির্দেশ দিলেন।”

নর্থইস্ট নিউজ লিখেছে, ২০২৪ সালের ৩ আগস্ট ছিল শেখ হাসিনার শাসনামলের গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন। সে সময়ের মধ্যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন রক্তক্ষয়ী রূপ নিয়েছে, সংঘাত-সহিংসতা প্রতিদিনের নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আওয়ামী লীগের একজন নেতাকে উদ্ধৃত করে প্রতিবেদনে বলা হয়, “একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে আরাফাত যে মন্তব্য করেছিলেন, যে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন মোকাবিলার মত যথেষ্ট বুলেট সরকারের হাতে আছে, তার প্রভাব হয়েছিল মারাত্মক। ওই মন্তব্য শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি ক্ষোভ আরও বাড়িয়েছিল। ওই সময় ওই কথা বলা নিছক বোকামি ছিল না, এটা সচেতনভাবে করা হয়েছিল।”

সেই নেতার ভাষ্য, আওয়ামী লীগও তখন ‘এক ধরনের দ্বিধান্বিত’ অবস্থায় পৌঁছেছিল, বা হয়ত ‘অদৃশ্য কোনো শক্তি’ দলটিকে নিয়ন্ত্রণ করছিল। ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে শোক মিছিল করার কথা ছিল আওয়ামী লীগের। এছাড়া চার থেকে পাঁচ লাখ কর্মী ও সমর্থককে রাজধানীর চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে জড়ো করার পরিকল্পনা ছিল।

নর্থইস্ট নিউজ লিখেছে, ৩০ জুলাই, যখন ছাত্র আন্দোলন আরো তীব্র হওয়ার আভাস মিলল, সালমান এফ রহমান তখন যত দ্রুত সম্ভব শেখ রেহানাকে যুক্তরাজ্য থেকে ঢাকায় আসতে অনুরোধ করেন। বড় ধরনের হতাহতের ঘটনা ঘটলে যে আওয়ামী লীগের ওই সমাবেশ বাতিল করতে হবে, তা হাসিনাকে বোঝানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তার বোন রেহানাকে। আর আওয়ামী লীগের ওই কর্মসূচি বাতিলের ঘোষণা দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছিল দলের দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার ওপর।

আওয়ামী লীগের ওই নেতাকে উদ্ধৃত করে ভারতীয় পত্রিকাটি লিখেছে, “যখন দলের নেতারা সমাবেশ চালিয়ে যাওয়ার পক্ষে মত দিলেন, শেখ রেহানা রোষে ফেটে পড়লেন। উপস্থিত নেতাদের বললেন, ‘যা বলা হচ্ছে তাই কর’। ফলে ওই সমাবেশ বাতিল হয়ে যায়। ফলে ইসলামী ছাত্রশিবির, জামায়াতে ইসলামী ও বিএনপির কর্মী ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিক্রিয়া দেখানোর সুযোগও শেষ হয়ে যায়।”

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর এক বছর পেরিয়েছে, কলকাতায় অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতারা এখন দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি ক্ষুব্ধ বলে নর্থইস্ট নিউজকে জানিয়েছেন সেই নেতা। তিনি বলেছেন, “তারা অভিযোগ করেছেন যে, যখন দল ক্ষমতায় ছিল এবং সবকিছু মসৃণভাবে চলছিল, তখন তারা অচল হয়ে গিয়েছিলেন। দল বা সরকারের কোনো বিষয় নিয়ে তারা খোলাখুলি মত প্রকাশ করার সুযোগ পাননি। তাই কোনো সত্যিকারের সমালোচনা হয়নি, মূল্যায়নের সুযোগও ছিল না। তখন ভয় ছিল, কথা বললে হয়ত দলীয় বা সরকারি পদ হারাতে হবে।”

পত্রিকাটি লিখেছে, আওয়ামী লীগ নেতারা এখন মনে করছেন, শেখ হাসিনার ‘বিচ্ছিন্নতার’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল ৮ থেকে ১০ জুলাইয়ের ‘বিপর্যয়কর’ চীন সফর। নির্ধারিত তারিখের এক দিন আগে তার দেশে ফেরার মধ্যে এই ইঙ্গিতই মিলেছিল যে, তার চীন সফরের পরিকল্পনা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগের একজন নেতা নর্থইস্ট নিউজকে বলেছেন, ভারতও ওই সময় শেখ হাসিনার প্রতি নাখোশ ছিল, কারণ তাদের বিচারে ওই সময় তার চীন সফর ছিল কৌশলগতভাবে ‘ভুল সিদ্ধান্ত’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *