দেশের অন্যতম বৃহৎ ইসলামী রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীরও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবর ক্রমেই প্রকাশ্যে আসছে। বিশেষ করে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় দলটির তৃণমূল পর্যায়ে কয়েকটি আসনে দেখা দিয়েছে বিরোধ ও অসন্তোষ। দীর্ঘদিন ধরেই সুশৃঙ্খল হিসেবে পরিচিত এই দলের মধ্যে চারটি আসনে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব দেখা গেছে, আর আরও চারটি আসনে অপ্রকাশ্য বিরোধ রয়েছে বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐতিহ্যগতভাবে অত্যন্ত সুসংগঠিত এবং চেইন অব কমান্ডে বিশ্বাসী জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন ইউনিটে এখন নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ মাথাচাড়া দিচ্ছে, যার সরাসরি প্রভাব পড়েছে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায়। মূলত চারটি গুরুত্বপূর্ণ আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণায় বিলম্ব করেছে জামায়াত, যা দলের সাংগঠনিক শৃঙ্খলার ক্ষেত্রে এক বিরল ও নেতিবাচক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। আরও বেশ কয়েকটি আসনেও প্রার্থী বাছাই নিয়ে ভেতরে ভেতরে অসন্তোষ বিরাজ করছে। তবে জামায়াতের দায়িত্বশীল নেতারা বলছেন, তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মতামত নিয়েই তারা সংসদ সদস্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। কয়েকটি আসনে দ্বন্দ্বের খবরটি যেভাবে বলা হচ্ছে, সেটি সঠিক নয়। তবে দু-একটি আসনে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিল। মানুষ তো আর ভুলের ঊর্ধ্বে নয়। এখন দেশের তিনশ আসনেই জামায়াতের প্রার্থী আছে এবং সবাই সংশ্লিষ্ট প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছেন।
আসন্ন নির্বাচন ঘিরে দেশের প্রায় সবকটি আসনেই সম্ভাব্য প্রার্থীর প্রাথমিক তালিকা তৈরি করে গণসংযোগ শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলকভাবে নতুন ও তরুণ নেতৃত্বকে সামনে আনার কৌশলও নিয়েছে। তবে ব্যতিক্রম ঘটেছে চারটি আসনে, যেখানে একাধিক শক্তিশালী নেতা প্রার্থী হতে আগ্রহী হওয়ায় চূড়ান্ত মনোনয়ন নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়।
দলটির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, জামায়াতের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে মনে করা হচ্ছে। তার অন্যতম প্রবীণ বনাম নবীনের দ্বন্দ্ব। কেননা, অনেক আসনে তরুণ এবং উচ্চ শিক্ষিত ও অপেক্ষাকৃত কম পরিচিত মুখকে প্রার্থী হিসেবে প্রাথমিক মনোনয়ন দেওয়ায় মনোনয়নপ্রত্যাশী প্রবীণ নেতাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। প্রবীণ নেতারা মনে করছেন, দলের জন্য তাদের দীর্ঘদিনের ত্যাগ ও অবদানের সঠিক মূল্যায়ন হয়নি। সেইসঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু আসনে স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী একাধিক নেতার মধ্যে প্রার্থী হওয়ার জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা অনেক সময় স্থানীয় কমিটিকেও বিভক্ত করে ফেলেছে।
এদিকে নির্বাচন ও জোট-সংক্রান্ত কৌশল নিয়েও দলের ভেতরে ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। এক পক্ষ যেখানে এককভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে চাইছে, সেখানে অন্য পক্ষ বৃহত্তর ইসলামী জোটের পক্ষে। এই কৌশলগত বিভেদও অনেক সময় প্রার্থী মনোনয়নে প্রভাব ফেলছে। তবে জামায়াত এককভাবে নির্বাচন করবে নাকি, কোনো জোটে যোগ দেবে, এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হওয়ার আগেই এমন কোন্দল দলের দরকষাকষির ক্ষমতাকেও দুর্বল করে দিচ্ছে বলে মনে করছেন দলের দায়িত্বশীল নেতারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পাবনা-৫ (সদর), ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া), কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে প্রার্থী মনোনয়নের বিষয়ে প্রকাশ্য বিরোধ, বিক্ষোভ এবং প্রার্থীকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার ঘটনা ঘটেছে। পাবনা-৫ আসনে অধ্যক্ষ ইকবালকে প্রার্থী করেছে জামায়াত। এ ছাড়া নরসিংদী-৫ (রায়পুরা) আসনে তৃণমূলের আপত্তিতে প্রার্থিতা নিয়ে অসন্তোষ দেখা দেয়। সেখানে মাওলানা জাহাঙ্গীরকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়াও প্রকাশ্য বিরোধের মধ্যে আছে সিলেট-৫, কুষ্টিয়া-৩, চট্টগ্রাম-১৫ ও গাজীপুর-৬ আসন। কুমিল্লার দুটি আসনেও অসন্তোষের খবর পাওয়া গেছে।
জানা যায়, ময়মনসিংহ-৬ আসনে মনোনয়ন না পাওয়ায় সাবেক জেলা আমির অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের সব সাংগঠনিক পদ স্থগিত করা হয়। অন্যদিকে তার সমর্থকরা নতুন প্রার্থী অধ্যক্ষ কামরুল হাসান মিলনকে ফুলবাড়ীতে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। কুমিল্লা-৭ (চান্দিনা) আসনে গত ২৭ অক্টোবর উত্তর জেলা জামায়াতের গণমিছিলে দুপক্ষের মধ্যে হাতাহাতি ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এক পক্ষের দাবি, সম্ভাব্য প্রার্থী মাওলানা মোশাররফ হোসেন আওয়ামী লীগের দোসর। ছাত্রশিবিরের সাবেক নেতা সাজিদ আল-আমিন জানান, জেলা আমির ও সেক্রেটারি অবৈধভাবে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। তবে মোশাররফ হোসেন সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। পাবনা-৫ আসনে সাবেক এমপি অধ্যক্ষ ইকবাল হোসেনকে বাদ দিয়ে স্থানীয় নেতারা তিনবারের এমপি আব্দুর রহিমকে প্রার্থী করার দাবি জানান।
অভ্যন্তরীণ মনোমালিন্য এবং অসন্তোষের আরও উদাহরণ আছে। তার মধ্যে চট্টগ্রাম-১৫, কুষ্টিয়া-৩, সিলেট-৫ ও গাজীপুর-৬ আসন। চট্টগ্রাম-১৫ ও কুষ্টিয়া-৩ আসনে স্থানীয় প্রার্থীর পরিবর্তন কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তে হয়েছে, যা তৃণমূলের মধ্যে বিরোধের সৃষ্টি করেছে। সিলেট-৫ আসনে জনপ্রিয় ও প্রভাবশালী স্থানীয় প্রার্থী বাদ দিয়ে নতুন প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছে দলটি। গাজীপুর-৬ আসনে কেন্দ্রের পছন্দে বিদেশ থেকে আসা প্রার্থী ড. হাফিজুর রহমানকে মনোনয়ন দেওয়ায় স্থানীয় তৃণমূলের অসন্তোষ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঐতিহাসিকভাবে জামায়াতের অন্যতম শক্তি ছিল তার কঠোর সাংগঠনিক শৃঙ্খলা এবং কেন্দ্রীয় কমান্ডের প্রতি আনুগত্য; কিন্তু কয়েকটি আসনে প্রার্থী দিতে বিলম্ব হওয়া এবং একাধিক স্থানে কোন্দল প্রকাশ্যে আসার ঘটনা দলটির সেই শৃঙ্খলায় ফাটল ধরিয়েছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। পূর্বে জামায়াত এমন কোন্দল অত্যন্ত গোপনীয়তার সঙ্গে নিরসন করত। বর্তমানে তা প্রকাশ্যে আসায় দলের সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যেও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।
অন্যদিকে, জামায়াতের শীর্ষ নেতারা অভ্যন্তরীণ কোন্দলের খবরকে সামান্য মতপার্থক্য হিসেবে দেখিয়ে দাবি করছেন, এটি একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার অংশ। তারা বলছেন, ৩০০ আসনে প্রার্থী চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়ায় অল্প কিছু আসনে এমন জটিলতা আসতেই পারে এবং আলোচনার মাধ্যমে দ্রুতই সেই সমস্যা সমাধান হবে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, দলীয় ঐক্য এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখা তাদের মূল লক্ষ্য। প্রার্থী মনোনয়ন-সংক্রান্ত বিরোধ নিয়ন্ত্রণে আনতে কেন্দ্রে কাজ চলছে, যাতে নির্বাচনের মাঠে দলের শক্তি বিভাজিত না হয়।
জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম গতকাল কালবেলাকে বলেন, তৃণমূলের নেতাকর্মীদের মতামতের ভিত্তিতেই নিয়মতান্ত্রিকভাবে প্রার্থী দেওয়া হয়েছে। কোনো নিয়মের ব্যত্যয় ঘটেনি। যারা বিক্ষোভ করেছে, সেটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। তবে সেটি কাম্য নয়। ভুল-ত্রুটি মানুষের হয়। এখন সব আসনেই জামায়াতের এমপি প্রার্থী আছে। নির্বাচনের আগেই সব ঠিক হয়ে যাবে ইনশাআল্লাহ।