গুলিতে মৃত্যুর পরও কাটা হয় রগ

সারাদেশ

খুলনার দৌলতপুরে যুবদলের বহিষ্কৃত নেতা মাহবুবুর রহমানকে হত্যার ক্লু এখনো পরিষ্কার নয়। খুনিদের ধরতে পুলিশের একাধিক টিম মাঠ চষে বেড়ানোর তথ্য জানানো হলেও ঘটনার ২৪ ঘণ্টা পরও ধরা পড়েনি কেউ। তবে দুটি বিষয়কে সামনে রেখে তদন্তে জোর দেওয়া হচ্ছে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এলাকার একটি গ্রুপের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মাহবুবুরের। মাদক কারবারেও তার সংশ্লিষ্টতার জনশ্রুতি আছে। এ ছাড়া খুলনায় এর আগে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটেছে, তার সঙ্গে মাহবুবুর হত্যার ধরনে পার্থক্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। একাধিক পিস্তল দিয়ে গুলি এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তার পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়।

জানা গেছে, আলোচিত এ হত্যাকাণ্ডের সময় মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্তের একজনের মাথায় হেলমেট থাকলেও বাকি দুজনের মুখ খোলা ছিল। খুনিরা মহেশ্বরপাশা পশ্চিম এলাকা দিয়ে ঢুকে ৩০ মিনিটের কিলিং মিশন সম্পন্ন করে আবার তেলিগাতি দিয়ে বের হয়ে যায়। এ-সংক্রান্ত একাধিক সিসিক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেছে পুলিশ।

খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি) উপকমিশনার তাজুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এলাকার একটি গ্রুপের সঙ্গে তার (মাহবুবুর) দ্বন্দ্ব ছিল। এ ছাড়া মাদককাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার জনশ্রুতি আছে। আমরা সব বিষয়কে সামনে রেখে তদন্ত করছি।’

এই পুলিশ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের সময়ে তিনজন সন্ত্রাসী ছিল। তাদের সবার হাতে পিস্তল ছিল। সেখানে মাহবুবকে লক্ষ্য করে তারা ৭ রাউন্ড গুলি ছুড়েছে। হত্যাকারীরা মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া দিয়ে মাহবুবের বাড়ির সামনে গিয়ে গুলি করে ৩০ মিনিটে হত্যাকাণ্ডটি সম্পন্ন করে তেলিগাতি হয়ে হাইওয়ে রাস্তা দিয়ে বের হয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যায়। আমরা ঘটনাস্থলের পাশের একটি সিসিক্যামেরা ফুটেজ সংগ্রহ করেছি। আরও একটি সংগ্রহের চেষ্টায় আছি। তবে এ মামলায় সাধারণ মানুষ যেন হয়রানি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা হবে। মূল আসামিদের গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত কোনো কিছুই পরিষ্কার করে বলা যাচ্ছে না।’

যুবদলের সাবেক নেতা মাহবুব হত্যার ঘটনায় তার বাবা আব্দুল করিম মোল্লা অজ্ঞাতপরিচয়দের আসামি করে দৌলতপুর থানায় একটি মামলা করেছেন। গতকাল শনিবার দুপুরে দৌলতপুর থানায় এ মামলা করেন তিনি। মামলায় আসামিদের কারও নাম ও সংখ্যা নির্দিষ্ট নয়। দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বলেন, পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ঘটনার সময় মাহবুবের সঙ্গে থাকা ভ্যানচালক সোলেমানকে হেফাজতে নিলেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। মামলার এজাহারে দেওয়া বর্ণনার পাশাপাশি এলাকায় মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারের বিরোধ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের নামে মামলা দেওয়া, উঠতি চরমপন্থি কানেকশন ও কুয়েটে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিরোধসহ একাধিক ক্লু সামনে রেখে মাঠ চষে বেড়াচ্ছে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) ও দৌলতপুর থানা পুলিশের একাধিক টিম। অন্যদিকে মাহবুবের বাড়িতে এখনো চলছে শোকের মাতম। বাবাকে হারিয়ে তার দুই শিশুকন্যার আহাজারি থামছে না।

ময়নাতদন্ত শেষে গত শুক্রবার সন্ধ্যার পর মাহবুবের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। রাতে এশার নামাজের পর জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয় তাকে।

গতকাল বেলা ১১টায় দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশা পশ্চিমপাড়া এলাকায় নিহত মাহবুবের বাসায় গিয়ে দেখা যায়, কেএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (প্রশাসন) আবু সালেহ মো. রায়হান, উপকমিশনার (ডিবি) মো. তাজুল ইসলাম ও দৌলতপুর থানার ওসি মীর আতাহার আলী বাড়িতে থাকা মাহবুবের স্ত্রী এরিনা সুলতানা, শ্বশুর আজাদ বেগ বাবুসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে কথা বলছেন।

পরে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার আবু সালেহ মোহাম্মদ রায়হান বলেন, ‘আমরা অনেক বিষয় সামনে নিয়ে কাজ করছি।

খুলনায় আগে যে হত্যাকাণ্ডলো ঘটেছে তার সঙ্গে এটার প্যাটার্ন একটু আলাদা।

একাধিক পিস্তল দিয়ে গুলি করা হয়েছে এবং মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়েছে। আমরা সম্ভাব্য সব বিষয় মাথায় নিয়ে তদন্ত শুরু করেছি। এ ব্যাপারে এখনই বেশি তথ্য দেওয়া সম্ভব হবে না। তবে আশা করি খুব দ্রুত হত্যাকারীদের গ্রেপ্তার করে আইনের আওতায় নিয়ে আসতে পারব।’

মাহবুবের স্ত্রী এরিনা সুলতানা বলেন, ‘মানিকতলায় বিএনপির সুধীসমাবেশে হামলার ঘটনা নিয়ে মাহবুবকে হুমকি দেওয়া হতো। মাহবুবের এক বন্ধু ও স্থানীয় বিএনপি নেতা জাকির ওই মামলার বাদী ছিলেন। ওই মামলায় আসামি দেওয়া নিয়ে মাহবুবকে বাসার সামনে রিভলবার ঠেকিয়ে হুমকি দিয়ে গিয়েছে। আমি অসুস্থ থাকায় মাহবুব আমার কাছে প্রথমে বিষয়টি লুকিয়েছে, কিন্তু আমি আমার বাবার কাছে শুনলে মাহবুব স্বীকার করে এবং বলে আমার কিছু হবে না, আমি কিছু করিনি, যা করেছি দলের সিদ্ধান্ত নিয়ে করেছি। নিরপরাধ কাউকে মামলায় আসামি করা হয়নি। যাদের নাম বলেছিল তাদের নাম আমি এখনই বলার মতো শারীরিক ও মানসিক অবস্থায় নেই।’

স্থানীয়রা জানায়, এলাকায় মাদক কারবার ও আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে ওই এলাকারই আরেকটি গ্রুপের সঙ্গে মাহবুবুবের দ্বন্দ্ব ছিল দীর্ঘদিনের। কুয়েটের টেন্ডার সিন্ডিকেট, মাদক ও এলাকায় আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মহেশ্বরপাশা, তেলিগাতী ও কুয়েট এলাকায় কয়েকটি গ্রুপ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। মহেশ্বরপাশা খানা বাড়ি এলাকায় একটি বাড়ি দখল নিয়ে মাহবুবের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি হয় স্থানীয় ব্যবসায়ী সাহেদের। পরে বিএনপির সুধীসমাবেশে হামলার ঘটনায় সাহেদকে ২০ নম্বর আসামি করা হয়।

এক যুবদল নেতা বলেন, ‘৫ আগস্টের পর স্থানীয় বিএনপির সর্বোচ্চ নেতার সঙ্গে বিশেষ সখ্য এবং উঠতি চরমপন্থি এক নেতার ভাই হওয়ায় মাহবুব ছিল বেশ বেপরোয়া। হত্যাকাণ্ডের সময় যে গাড়িটি মাহবুব নিজের গাড়ি উল্লেখ করে পরিষ্কার করছিল, সেটিও স্থানীয় যুবলীগ নেতা জাহিদের কাছ থেকে জোর করে দখল নেওয়া।’

এ প্রসঙ্গে মাহবুবের চাচাতো ভাই আশরাফুল বলেন, ‘জাহিদ ভাই যুবলীগ করতেন। কিন্তু আমাদের এলাকার মানুষ হওয়ায় জাহিদ ভাই মাহবুব ভাইয়ের কাছে গাড়িটি বন্ধক রাখেন। সে হিসেবে মাহবুব ভাই গত ১৫ দিন ধরে গাড়িটি চালাত।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *