‘ছেলেরা প্রাইভেটকারে করে প্র্যাকটিসে আসে, আর আমাদের মাস চলে না’

খেলা

চলতি বছরের শুরুতেই মাঠে গড়িয়েছিল নারী অনূর্ধ্ব-১৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে। যেখানে দুর্দান্ত পারফরম করে বাংলাদেশকে সুপার সিক্সে তুলতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন জুয়ায়রিয়া ফেরদৌস জয়িতা। বর্তমানে বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে খেলার স্বপ্ন দেখছেন এই ওপেনার ব্যাটার।

ক্রিকেট ক্যারিয়ার ও নিজের পরিবারসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আরটিভির ক্রীড়া প্রতিবেদক হাবিবুল কবীর সম্রাটের সঙ্গে কথা বলেছেন জয়িতা। সেখানে নিজের মূল লক্ষ্য হিসেবে নিজের দেশকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে চান বলে জানান তিনি। এ ছাড়াও বিসিবির বেতন কাঠামো নিয়েও কথা বলেছেন এই তরুণী।  

আরটিভি নিউজ: পরিবার থেকে খেলার জন্য কে বেশি সাপোর্ট করে?

ফেরদৌস জয়িতা: আমার আম্মু সব থেকে বেশি সাপোর্ট করে। আজ আমি এ পর্যন্ত এসেছি আমার আম্মুর জন্য। হয়তো তিনি না থাকলে এ পর্যন্ত আর আসতে পারতাম না। আমাকে খেলাধুলায় আনতে তাকে আমার পরিবারের মানুষের কাছ থেকে অনেক কথা শুনতে হয়েছে, কিন্তু তিনি আমাকে সবসময় সাপোর্ট করে গেছেন খেলাধুলার জন্য। 

আরটিভি নিউজ: আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার জন্য সময় বের করেন কীভাবে

ফেরদৌস জয়িতা: পড়াশোনা তো সবার প্রথমে। আমার ভার্সিটি টিচাররা আমাকে অনেক সাপোর্ট করেন। সবসময় পড়াশোনার ব্যাপারে অনেক হেল্প করেন। যেহেতু খেলাধুলা করি, সকালে প্র্যাকটিস থাকে। প্র্যাকটিস করার পরে ভার্সিটিতে ক্লাসে যাই, ক্লাস করি। যখন কোনো ক্যাম্প থাকে তখন টিচাররা অনেক হেল্প করেন, ছুটি দেন। আমার ফ্রেন্ডরা অনেক হেল্প করে। আমি যখন ক্লাস করতে পারি না, ক্লাসের পড়াশোনা সবকিছু বলে দেয়, কীভাবে করতে হবে, কী পড়িয়েছে টিচাররা—এভাবেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যাচ্ছি। 

আরটিভি নিউজ: আইসিসি অনূর্ধ্ব ১৯ বিশ্বকাপ আপনার কেমন কেটেছে?

ফেরদৌস জয়িতা: আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো কেটেছে। প্রথমবার ওয়ার্ল্ড কাপ খেলার সুযোগ পেয়েছিলাম প্র্যাকটিস ম্যাচগুলোতে। আলহামদুলিল্লাহ ভালো করেছিলাম। তারপর আমাদের গ্রুপ পর্যায়ের খেলা শুরু হয়। সেখানে আমরা গ্রুপ পর্যায়ে রানার-আপ হয়েছিলাম। সেখানে আমি তেমন কিছু দেখাতে পারিনি। কিন্তু আমরা যখন সুপার সিক্সে উঠি, তখন সুপার সিক্সের প্রথম ম্যাচ হয় স্কটল্যান্ডের সাথে সেখানে হয়েছিল। আমি আমার দলের হয়ে ২০  রান সংগ্রহ করি। ম্যাচটা আমরা উইন করি। তারপরের ম্যাচটা ছিল ইন্ডিয়ার সাথে, সেখানে আমাকে ড্রপ দেওয়া হয়। তার পরের ম্যাচ ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে, সেখানে আমি ২৮ বলে ২৫ রান করে অপরাজিত ছিলাম।

আলহামদুলিল্লাহ আমরা খুব ভালোভাবে উইন করেছিলাম। বিশ্বকাপের এত বড় একটা আসরে এসে আমরা আমাদের শেষটা ভালো করতে পেরে অনেক ভালো লেগেছিল। যদিও আমরা ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারিনি, কিন্তু শেষ ম্যাচটা ওয়েস্ট ইন্ডিজ সাথে খুব ভালো কবে জিতে আমরা একটু হলেও খুশি ছিলাম।

আরটিভি নিউজ: বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আপনার সেই ইনিংস নিয়ে কী বলবেন?

ফেরদৌস জয়িতা: আলহামদুলিল্লাহ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে আমাদের বিশ্বকাপের ছিল শেষ ম্যাচ। শেষটা ভালো করা আমাদের জন্য এবং আমাদের দেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সেটা অর্জন করি এবং আমি সেখানে ২৮ বলে ২৫ রান করে অপরাজিত ছিলাম। নিজেকে প্রমাণ করার একটা সুযোগ ছিল ওইদিন। এবং সেটা আমি আমার তরফ থেকে করার চেষ্টা করেছিলাম নিজের দলের জন্য নিজের দেশের জন্য। আল্লাহর কাছে অনেক অনেক শুকরিয়া সে আমাকে সে তৌফিক দান করেছিলেন। আমাদের হেড কোচ সরোয়ার ইমরান স্যার, তিনি আমার ওপর অনেক ভরসা করতেন। আমি ভালো কিছু করতে পারব বলে তার যে ভরসা ছিল, সেটি রাখার চেষ্টা করেছিলাম।

আরটিভি নিউজ: অবসরে কী করা হয়?

ফেরদৌস জয়িতা: ফ্যামিলির সাথে অবসর কাটাতে পছন্দ করি। রান্না করা আমার অনেক শখ, সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকি।

আরটিভি নিউজ: দেশের ভেতরে আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?

ফেরদৌস জয়িতা: দেশের ভেতরে আমার সবথেকে প্রিয় খেলোয়াড় মেয়েদের মধ্য থেকে নিগার সুলতানা জ্যোতি আপু। তিনি যেমন খেলেন, তেমন উইকেট কিপিং করেন। আমিও ব্যাটসম্যান উইকেট কিপার। এ জন্য তাকে আমার খুব পছন্দ এবং তিনি আমাদের জাতীয় দলের ক্যাপ্টেন। অনেক সুন্দর নেতৃত্ব দেন তিনি।  জ্যোতি আপু অনেক সুন্দর ব্যাটিং করেন। তার ব্যাটিংয়ের ফ্যান আমি।

আরটিভি নিউজ: দেশের বাহিরের আপনার প্রিয় খেলোয়াড় কে?

ফেরদৌস জয়িতা: সারা টেইলার ও বিরাট কোহলির ব্যাটিং আমার সবথেকে ফেভারিট। বিরাট কোহলি ওয়ার্ল্ড ক্লাস একজন ব্যাটসম্যান। তার ব্যাটিং সবারই নজর কাড়তে বাধ্য এবং সারা টেইলার ইংল্যান্ডের একজন নারী ক্রিকেট খেলোয়াড়। তিনি উইকেট কিপার ব্যাটসম্যান। খুবই দুর্দান্ত ব্যাটিং এবং কিপিং করেন তিনি। এ জন্য তাকে আমার সবথেকে বেশি ভালো লাগে। তার কিপিংয়ের বেসিক তার ব্যাটিং খুবই সুন্দর।

আরটিভি নিউজ: বাংলাদেশের মেয়েরা বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছে, তাদের জন্য আপনার কী মেসেজ? 

ফেরদৌস জয়িতা: আলহামদুলিল্লাহ, বাংলাদেশ ক্রিকেট নারী টিম বিশ্বকাপ খেলা নিশ্চিত করেছে। অনেক কঠোর পরিশ্রমের পর তারা বিশ্বকাপ নিশ্চিত করেছে। তাদের পরিশ্রমের কোনো তুলনা হয় না। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা দিন-রাত কষ্ট করে আসছে। তাদের জন্য সবসময় অনেক অনেক দোয়া থাকবে। তারা সুস্থ-সুন্দরভাবে বিশ্বকাপ খেলে আসুক এবং দেশের সুনাম অর্জন করে নিয়ে আসবে, ইনশাআল্লাহ।

আরটিভি নিউজ: খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? 

ফেরদৌস জয়িতা: খেলোয়াড় হিসেবে অবশ্যই নিজেকে বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট টিমে দেখতে চাই। নিজের দেশকে পৃথিবীর বুকে তুলে ধরতে চাই—এটা আমার জীবনের সবথেকে বড় স্বপ্ন।

আরটিভি নিউজ: নারীদের খেলা নিয়ে সমাজের কিছু মানুষের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। কখনো কোনো প্রতিকূল পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন কিনা? 

ফেরদৌস জয়িতা: আসলে বাংলাদেশে মেয়েদের খেলাটা সবাই ভালো চোখে দেখে না। গ্রাম-গঞ্জে এখনো মেয়েদের বাল্যবিবাহ দেওয়া হয়। তার মধ্যে মেয়েদের খেলাধুলা করা অনেক কষ্ট। পরিবার থেকে সাপোর্ট করে না। পরিবার থেকে সাপোর্ট করলে আশপাশের মানুষজন নানা কূটনৈতিক কথাবার্তা বলে থাকে। এটা আমার সাথে হয়েছে। আমার আম্মু একজন ক্রীড়া শিক্ষক। এ জন্য আম্মু সবসময় আমাকে অনেক সাপোর্ট করে এসেছেন খেলাধুলার ব্যাপারে। কিন্তু আশপাশের মানুষ নানা কথাবার্তা বলত। ছেলেদের পোশাক পরে খেলা। ছেলেদের পোশাক পরে মাঠে দৌড়ানো—এ ধরনের অনেক কথাবার্তা। তারপরও আমার আম্মুর সাপোর্টে আমি আজ এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। সব বাধা পেরিয়ে আমার আম্মু  সবসময় আমার সাথে ছিল এবং সবকিছুর প্রটেস্ট করতেন, এ জন্যই আজ আমি এই পর্যন্ত।

আরটিভি নিউজ: বেতন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট কি না?

ফেরদৌস জয়িতা: মেয়েরা সবসময় অবহেলার পাত্রই হয়ে থাকে। 

আমাদের বাংলাদেশের ছেলেরা যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তাদের অনেক বেতন। তারা গাড়ি নিয়ে আসে প্র্যাকটিস করতে। কিন্তু দেখেন, মেয়েদেরকে আসতে হয় সিএনজিতে বা রিকশায়। কারণ, তাদের বেতন এতই স্বল্প যে, তাদের পরিবারের বাইরে তাদের আরাম-আয়েশের জন্য কিছু করার ক্ষমতা নেই। সে পরিমাণ টাকা তারা পায় না। ছেলেদের অর্ধেকও মেয়েরা পায় না।
জুয়ায়রিয়া ফেরদৌস জয়িত

বাংলাদেশ ক্রিকেটে শুধু ন্যাশনাল টিমই বেতন পেত। কয়েক মাস আগে ন্যাশনাল টিমের বাইরে ২০ জনকে ২৫ হাজার টাকা বেতনের তালিকায় আনা হয়। কিন্তু এই স্বল্প পরিমাণ টাকা এবং এই স্বল্প পরিমাণ খেলোয়াড়কে বেতন দিলে আমাদের বাংলাদেশর ক্রিকেট কীভাবে এগিয়ে যাবে? 

‘আমাদের মতোন মেয়েরা; আমরা ঢাকায় থেকে প্র্যাকটিস করি। আমাদের বাসা ভাড়া, প্র্যাকটিস খরচ, খাওয়াদাওয়া—সবকিছুই নিজেদেরকে অ্যারেঞ্জ করতে হয়। বছরে একটা খেলা প্রিমিয়ার লিগ, ওটা থেকেও খুব বেশি টাকা আসে না। কত মেয়েরা এভাবে খেলা ছেড়ে দিয়েছে। তারা ঠিকভাবে প্র্যাকটিস করতে পারে না। বাসা থেকে তাদেরকে ঠিকভাবে টাকা-পয়সা দেয় না প্র্যাকটিস করার জন্য। তাদের নিজেদের চলার মতো টাকা থাকে না। যদি বিসিবি আরও কিছু মেয়েকে বেতনভুক্ত করত, তাহলে হয়তো আরও নতুন নতুন খেলোয়ার তৈরি হতো ন্যাশনাল টিমের জন্য। বিসিবির কাছে আমার এটাই প্রত্যাশা থাকবে, মেয়েদের দিকে আরও নজর দেওয়া। কারণ, ছেলেরা যেমন দেশের জন্য খেলছে মেয়েরাও তেমন দেশের জন্যই খেলছে। ছেলেরা যেমন দেশের জন্য কাপ নিয়ে আসছে, মেয়েরাও তেমন দেশের জন্য কাপ নিয়েছে। তাহলে তাদেরকে কেন ছেলেদের তুলনায় বঞ্চিত করা হবে। ছেলেদের মতো পুরোপুরি সুযোগ-সুবিধা না দিলেও অন্তত তাদের অর্ধেকটা দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি।’

আরটিভি নিউজ: কী ধরনের পদক্ষেপ নিলে নারী ক্রিকেট আরো এগিয়ে যাবে?

ফেরদৌস জয়িতা : নারী ক্রিকেট আরও এগিয়ে নিতে হলে প্রথমত আমাদের ঘরোয়া পর্যায়ে আরও বেশি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা দরকার। স্কুল, কলেজ এবং জেলা পর্যায় থেকে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের খুঁজে বের করে তাদের জন্য উন্নত প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি, নারী ক্রিকেটারদের জন্য পর্যাপ্ত স্পন্সরশিপ, ভালো কোচিং স্টাফ, ফিটনেস ট্রেনার, এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করে পরিবার এবং সমাজ থেকে মেয়েদের খেলাধুলায় আরও বেশি সমর্থন নিশ্চিত করা।

আরটিভি নিউজ: বিসিবির এক্ষেত্রে কী ধরনের ভূমিকা রাখা উচিত বলে মনে করেন?

ফেরদৌস জয়িতা: আমি মনে করি বিসিবি (বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড) নারী ক্রিকেটের উন্নতির জন্য আরও অবকাঠামোগত এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিতে পারে। নিয়মিতভাবে স্কুল ও জেলা পর্যায়ে নারী ক্রিকেট প্রতিযোগিতা আয়োজন, বিশেষায়িত একাডেমি স্থাপন এবং আন্তর্জাতিক ম্যাচের সংখ্যা বাড়ানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি, নারী ক্রিকেটারদের জন্য আরও ভালো আর্থিক সুবিধা, যেমন সম্মানজনক বেতন, ম্যাচ ফি, এবং পারফরম্যান্স ভিত্তিক বোনাস চালু করা দরকার। এতে মেয়েরা পেশাদারত্বের সাথে ক্রিকেটকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে আরও বেশি অনুপ্রাণিত হবে। এ ছাড়া, মিডিয়া কাভারেজ বাড়ানো এবং নারী ক্রিকেটারদের সাফল্য প্রচারের মাধ্যমেও বিসিবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। আমি বিশ্বাস করি, এসব উদ্যোগ একত্রে নারী ক্রিকেটকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *