গায়েব ১৫০ দিন, ভারত থেকে ফিরেই বৈঠকে—মেজর সাদিককে নিয়ে আরও যা জানা যাচ্ছে

সারাদেশ

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীদের ঢাকায় ‘গোপন বৈঠক’ এবং এর সঙ্গে এক সেনা কর্মকর্তার সরাসরি সম্পৃক্ততার খবর দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনেও চলছে নানা আলোচনা। গোপন বৈঠকে বাছাইকৃত ক্যাডারদের রাষ্ট্রবিরোধী প্রশিক্ষণ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে মেজর সাদেকুল হক সাদেক নামে সেনাবাহিনীর একজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। সেনাবাহিনীর হেফাজতে থাকা এই কর্মকর্তা গত ১৫০ দিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিলেন বলে জানা গেছে। তার সঙ্গে এই ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠেছে তার স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিনের বিরুদ্ধেও।

এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ তদন্ত আদালত গঠন করা হয়েছে বলে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) নিশ্চিত করেছে। শুক্রবার সেনা সদর দপ্তরে আয়োজিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে সামরিক অপারেশনস পরিদপ্তরের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজিম-উদ-দৌলা বলেন, ‘মেজর সাদেক সেনাবাহিনীর হেফাজতে আছেন। তদন্ত শেষে দোষ প্রমাণ হলে সেনাবাহিনীর প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ভাটারা থানার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় অবস্থিত কে বি কনভেনশন সেন্টারের দ্বিতীয় তলায় গত ৮ জুলাই এক গোপন বৈঠকের আয়োজন করা হয়। ‘বিদেশে লোক পাঠানোর নামে’ হলটি ভাড়া নেওয়া হলেও, সেখানে উপস্থিত হন আওয়ামী লীগ, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও সহযোগী সংগঠনের প্রায় ৪০০ নেতাকর্মী। তাদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন সরকারি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও। কৌশলে সংগৃহীত ওই দলের সদস্যদের শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তনের লক্ষ্যে ঢাকায় অরাজকতা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, বৈঠকের দিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ওই বৈঠকে সরকারবিরোধী স্লোগান দেওয়া হয় এবং শেখ হাসিনার প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করতে রাজধানীর শাহবাগ মোড় দখলের পরিকল্পনা হয়। বৈঠক ঘিরে অন্তত ২২ জন নেতাকর্মীকে ইতোমধ্যে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাদের সবার বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে ভাটারা থানায় মামলা করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তদন্তে উঠে এসেছে, মেজর সাদেক এই বৈঠকে উপস্থিত থেকে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করেন। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী সুমাইয়া জাফরিন। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন আগে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত পরিচিত মুখ। বৈঠকে অংশগ্রহণকারীদের দুই দিন আগেই একটি ‘টোকেন’ সরবরাহ করা হয়। এই ‘টোকেন’ দেখিয়ে তারা বৈঠকে প্রবেশ করেন।

ডিবি সূত্র জানিয়েছে, সোহেল রানা নামের বরগুনা জেলা যুবলীগ নেতা এবং গোপালগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেত্রী শামীমা নাসরিন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছেন, মেজর সাদেকের নির্দেশে তারা এই বৈঠকে লোক সংগঠিত করেন এবং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহায়তা করেন। পরে সেনা সদরের নির্দেশে মেজর সাদেককে ১৭ জুলাই তার বাসা থেকে আটক করে হেফাজতে নেওয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, বৈঠকের দিন কনভেনশন হলের সিসিটিভি ক্যামেরাগুলো পরিকল্পিতভাবে বন্ধ রাখা হয়। কনভেনশন সেন্টারের ব্যবস্থাপক মুজাহিদকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গোয়েন্দাদের ধারণা, হলের ভিডিও ফুটেজ নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

এদিকে তদন্তে আরও উঠে এসেছে, ঢাকার মিরপুর, ভাটারা, কাটাবন ও পূর্বাচল এলাকায় অন্তত চারটি স্থানে একই ধরনের প্রশিক্ষণ চালানো হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া তথ্যে দেখা যায়, ‘প্রিয় স্বদেশ’, ‘প্রজন্ম ৭১’, ‘বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম’, ‘শেখ হাসিনা’, ‘এফ ৭১ গেরিলা’সহ একাধিক হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এসব প্রশিক্ষণ ও বৈঠকের নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছিল।

আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, ‘প্রাথমিক তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। পূর্ণাঙ্গ তদন্ত শেষে প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে সেনাবাহিনীর প্রচলিত আইন ও বিধি অনুযায়ী যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’ অভিযুক্ত মেজরের বিচার হবে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ আদালত—কোর্ট মার্শালে।

তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবি কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের অবস্থান ও যোগাযোগ যাচাই করা হচ্ছে। আরও কয়েকজনকে রিমান্ডে এনে মুখোমুখি জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানানো হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *